সৌদি কি ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তির পথে?

সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

 

 

৪৩৯ বার দেখা হয়েছে

প্রায় এক মাস আগে ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের ঘোষণার পর এবার উপসাগরীয় রাষ্ট্র বাহরাইন ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিক করার ঘোষণা দিয়েছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প টুইটারে এক ঘোষণায় জানিয়েছেন, এই দুটি দেশ সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ”ঐতিহাসিক” এক চুক্তি করেছে। তিরিশ দিনের মধ্যে এটি দ্বিতীয় আরব দেশ, যারা ইসরায়েলের সাথে শান্তি চুক্তি করল। খবর বিবিসি বাংলার 

শুক্রবার ইসরায়েলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং বাহরাইনের বাদশা হামাদ বিন ইসা বিন সালমান আল-খালিফার মধ্যে এই চুক্তি হয়। আমিরাতের আগে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে মিশর ও জর্দান। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ নিয়ে এখন চারটি আরব রাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিল।

বিশ্লেষকদের নজর এখন সৌদি আরবের দিকে

ইসরায়েলের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সৌদি আরব সহ আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশ এখন কী অবস্থান নেয় সেদিকে নজর রাখছেন বিশ্লেষকরা। কয়েক দশক ধরে অধিকাংশ আরব দেশ ইসরায়েলকে বয়কট করে এসেছে এবং জোর দিয়ে বলেছে যে ফিলিস্তিনি বিবাদের মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত ইসরায়েলের সাথে তারা সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে না।

এখন একের পর এক আরব দেশ ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা।

সৌদি আরবের অবস্থান কী?

সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের মিত্র দেশ সৌদি আরব যদিও এখনও এ ব্যাপারে কোন প্রতিক্রিয়া জানায়নি, কিন্তু সৌদিরাও একই পথ অনুসরণ করবে কিনা সেদিকে নজর রাখছে আরব বিশ্বও।

মধ্যপ্রাচ্য ও ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে গবেষণা করেছেন অর্থনীতিবিদ ড. মুশতাক খান। তিনি বলছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করা সৌদি আরবের জন্য তার মতে এখন “শুধু সময়ের ব্যাপার”।

তিনি বলছেন সৌদি আরবে দেশের ভেতরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট ক্রমশ বাড়ছে।

“সৌদি আরব জানে তেল আজীবন থাকবে না, থাকলেও তেলের বাজার মূল্য কমবে। তেলের ওপর নির্ভর করে রাজত্ব চালানো যাবে না। দেশটিতে বেকারত্বের সমস্যাও বাড়ছে।”

ড. খান বলছেন, অর্থনীতি সচল ও শক্তিশালী রাখতে আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোর বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠার প্রয়োজনীয়তা সৌদি আরব অনুভব করছে। পাশাপাশি, তার মতে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগজিকে ২০১৮ সালে তুরস্কের ইস্তানবুলে সৌদি কনস্যুলেটে হত্যা করার ঘটনা নিয়ে বেকায়দায় ছিল সৌদি কর্তৃপক্ষ।

“জামাল খাসোগজির হত্যার পর সৌদি নেতৃত্ব বেশ খারাপ অবস্থানে ছিল। সেই সুযোগ নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন সৌদি কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ দিয়ে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ব্যাপারে একটা বোঝাপড়ায় পৌঁছে থাকতে পারে,” বলছেন ড. খান।

এছাড়াও, ইরান ও মধ্য প্রাচ্যে তার মিত্র দেশগুলোর যে “অক্ষ-শক্তি” তৈরি হচ্ছে তাতে সৌদি আরব ও তার মিত্র দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ সাম্প্রতিক কালে বেড়েছে। সেখানেও সৌদি আরব আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোর সহায়তা পেতে চাইছে।

“মধ্য প্রাচ্যে ইরানের সাথে সিরিয়া, ইরাক সেইসাথে লেবানন, তুরস্ক ও সম্ভবত কাতারের যে আঁতাত সম্প্রতি গড়ে উঠেছে, তাকে একটা নতুন ‘অক্ষ শক্তি’ এবং নিজেদের জন্য একটা বড় প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হিসাবে দেখছে সৌদি আরব।”

ড. খান বলছেন, ওই দেশগুলোর অর্থনীতি যেহেতু শুধু তেল-নির্ভর নয়, সেটাও সৌদি আরবের জন্য দুশ্চিন্তার আর একটা কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আমেরিকার সমর্থনের জন্য ইসরায়েলের সাথে একটা সমঝোতায় আসার ঘোষণা দেয়া এখন তাদের জন্য “শুধু সময়ের ব্যাপার” বলে তিনি মনে করছেন।

সৌদি আরব ও ইরান দ্বন্দ্ব

মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে আঞ্চলিক দ্বন্দ্বের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। ঐ অঞ্চলে গত কয়েক দশকে ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও শক্তি বাড়ায় উদ্বিগ্ন সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইসরায়েলের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ বাড়িয়েছে গত কয়েক বছর ধরে এবং পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইসরায়েলের সাথে সৌদি আরব এক ধরনের সখ্যতা গড়ে তুলেছে বলছেন বিবিসির সংবাদদাতা।

ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে ধর্মীয় আদর্শগত পার্থক্য দু দেশের কয়েক দশক-ব্যাপী বৈরিতায় বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহারাইন সৌদি আরবের মিত্র। তারাও শিয়া মতাবলম্বী ইরান সম্পর্কে তাদের উদ্বেগের কথা ইসরায়েলের কাছে বিভিন্ন সময়ে তুলে ধরেছে। এর মাধ্যমে ইসরায়েলের সাথে অনানুষ্ঠানিকভাবে আমিরাত ও বাহরাইনের যোগাযোগও বেড়েছে।

সৌদি আরব সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরইনের পথ অনুসরণ করে একইধরনের চুক্তির ঘোষণা দেয় কিনা সেটা বিশ্লেষকরা মনে করছেন এলাকার ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে।

বাহরাইন চুক্তিতে ফিলিস্তিনি প্রতিক্রিয়া

ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাহরাইনে তাদের রাষ্ট্রদূতকে দেশে ডেকে পাঠিয়েছেন এবং ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব এক বিবৃতিতে বলেছেন “এটা ফিলিস্তিনি জনগণের জাতীয় অধিকার এবং অখণ্ড আরব অবস্থানের জন্য বিশাল ক্ষতি।”

অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনের সমাজকল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রী আহমদ মাজদালানি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, গত মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে ইসরয়েলের শান্তি চুক্তি ঘোষণার মতই এ ঘোষণাও “ফিলিস্তিনি জনগণ এবং ফিলিস্তিনি আন্দোলনের পিঠে ছুরিকাঘাত”।

হামাস এই চুক্তিকে একটা “আগ্রাসন” বলে বর্ণনা করেছে। অধিকৃত এলাকা থেকে ইসরায়েলের প্রত্যাহার এবং একটা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে মেনে নেবার ব্যাপারে ফিলিস্তিনিরা দীর্ঘদিন ধরে একটা অখণ্ড আরব অবস্থানের ওপর নির্ভর করে এসেছে।

ইরানী সংসদে স্পিকারের আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা হোসেইন আমির-আবদোল্লাইয়ান রয়টার্স বার্তা সংস্থাকে বলেছেন ফিলিস্তিনি আন্দোলনের প্রতি এটা বিরাট বিশ্বাসঘাতকতা।

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, “বাহরইনের শাসকরা এখন থেকে ইহুদী প্রশাসকদের অপরাধের ভাগীদার হবেন এবং এলাকার নিরাপত্তা ও ইসলামী দুনিয়ার জন্য দেশটি একটা হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।”

ইরান কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর দমনপীড়ন, সহিংসতা, হত্যা ও যুদ্ধ চালানোর জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে।

ড. মুশতাক খান বলছেন, সৌদি আরব, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মত মধ্য প্রাচ্যের শক্তিশালী দেশগুলোর ইসরায়েলের সাথে শান্তি সমঝোতায় আসার দীর্ঘমেয়াদে একটা ইতিবাচক দিক আছে বলে তিনি মনে করেন।

তিনি বলেন, নব্বইয়ের দশকেই তার গবেষণায় তিনি বুঝেছিলেন, ফিলিস্তিনের জন্য দুই রাষ্ট্র সমাধান বাস্তবায়নের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। ইসরায়েল কখনই এই সমাধানের পক্ষে নয়। তবে তিনি মনে করেন ইসরায়েলের সাথে আরব বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে গেলে তা ভবিষ্যতে ইসরায়েলের জন্য নতুন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

“ইসরায়েল যদি সুন্নি বিশ্বের নেতৃত্ব দানকারী দেশগুলোর সাথে একটা সমঝোতায় আসে, এবং ফিলিস্তিনের স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবির প্রতি আরব দেশগুলোর অখন্ড সমর্থন না থাকে, তখন ফিলিস্তিনি ভূখন্ডের ৫০% মুসলিম নাগরিকের অধিকারের লড়াই সামনে চলে আসবে।”

ড. খান বলছেন সেই লড়াই সামাল দেয়া তখন ইসরায়েলের জন্য বড় একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।

ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া

বাহরাইনের এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, “এটি এলাকার জন্য আরেকটি ঐতিহাসিক অর্জন এবং এলাকার স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধিতে এই পদক্ষেপ ব্যাপক অবদান রাখবে।”

নেতানিয়াহু বলেছেন আরেকটি আরব দেশের সঙ্গে “শান্তি চুক্তিতে” পৌঁছাতে পেরে তিনি “উৎফুল্ল” এবং তিনি মনে করেন “এটি শান্তির পথে এক নতুন অধ্যায়।”

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিরোধ নিষ্পত্তিতে জানুয়ারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প “মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা” উপস্থাপন করেছিলেন। ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরইনের সমঝোতায়ও তিনিই মধ্যস্থতা করেছেন।

ট্রাম্প তার টুইট বার্তায় ইসরায়েল, আমেরিকা ও বাহরাইনের পক্ষে দেয়া যৌথ বিবৃতিটি পোস্ট করে বলেছেন “এই ঐতিহাসিক চুক্তি মধ্য প্রাচ্যে শান্তির পথ প্রশস্ত করবে এবং এলাকার নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করবে।”

আরো পড়ুন