সরকারি চাকরিজীবী বাবা চেয়েছিলেন লেখাপড়া শেষ করে সন্তানও যোগ দেবে সরকারি চাকরিতে; কিন্তু চাকরি তাকে টানেনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্টে লেখাপড়া করার সময়ই মাথায় ঢুকেছিল ব্যবসার চিন্তা। তবে ছিল না ব্যবসার পুঁজি ও জ্ঞান। তাই লেখাপড়া শেষ করে ব্যবসার অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য কয়েক বছর চাকরি করেছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। অভিজ্ঞতা অর্জন শেষেই নেমে পড়েছেন ব্যবসায়। মাত্র ২০ হাজার টাকায় ব্যবসা শুরু করে আজ প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার প্রতিষ্ঠানের মালিক। যার কথা বলা হচ্ছে, তিনি দেশের অন্যতম শিল্প পরিবারের কর্ণধার রানার গ্রুপের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান খান।
একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি তার ব্যবসায়ী জীবনের শুরু থেকে বর্তমান সময়ের গল্প বলেছেন। তার সাক্ষাৎকারের বিশেষ অংশ নিচে দেওয়া হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এসএম আলমগীর ।
এসএম আলমগীর : প্রথমেই আপনার ব্যবসার শুরুর দিককার কথা শুনতে চাই। ব্যবসা শুরু করলেন কীভাবে?
হাফিজুর রহমান খান : আমার ব্যবসা শুরুর দুটি ধাপ আছে। লেখাপড়া শেষ করার পর ব্যবসা শেখার জন্য আমি প্রথমে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি শুরু করি। পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি প্রাকটিক্যাল নলেজ গ্রহণের জন্যই মূলত চাকরিতে যোগ দিই। ১৯৭৮ সালে আমি যখন পড়াশোনা শেষ করি তখন দেশে প্রধান ব্যবসা ছিল পাটের ব্যবসা। সে কারণে প্রথমে পাটের ব্যবসা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করলাম। দু’বছর চাকরি করার পর বুঝলাম পাটের ব্যবসার ভবিষ্যৎ খুবই খারাপ, এ ব্যবসা হয়তো বেশি দিন টিকবে না। তখন পাটের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চাকরি ছেড়ে শ্যালো পাম্প মেশিন (পানি তোলার মেশিন) বিক্রি করে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে যোগ দিই। এখানে চাকরি করার সময় আমি শ্যালো মেশিনের ব্যবসা সম্পর্কে বেশ অভিজ্ঞতা অর্জন করি এবং চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৯৮৩ সালে আমি নিজেই শ্যালো মেশিন বিক্রির ব্যবসা শুরু করি। অর্থাৎ ১৯৭৮-৮৩ সাল; এই পাঁচ বছর আমি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি।
এসএম আলমগীর : কত টাকার পুঁজি নিয়ে আপনি ব্যবসা শুরু করেন?
হাফিজুর রহমান খান : আমার ব্যবসা শুরুর পুঁজি ছিল ২০ হাজার টাকা। অবশ্য পুরো টাকা আমার ছিল না, আমার পার্টনার ছিল আরও দুজন। অর্থাৎ আমরা তিনজনে মিলে শ্যালো মেশিন বিক্রির ব্যবসা শুরু করি। শ্যালো মেশিন বিক্রি করার সময়ই হোন্ডা কোম্পানির লোকদের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরে তাদের কাছ থেকে হোন্ডা নিয়ে দেশের বাজারে বিক্রি শুরু করি। পরে তো ২০০০ সালে আমরা রানার মোটরসাইকেল বিক্রি শুরু করি।
এসএম আলমগীর : লেখাপড়া শেষ করে তো চাকরিতে যোগ দিলেন, তাহলে ব্যবসার চিন্তাটা কখন মাথায় এলো?
হাফিজুর রহমান খান : আসলে চাকরি করতে গিয়ে ব্যবসার চিন্তা মাথায় এসেছে বিষয়টি তেমন নয়। ব্যবসার চিন্তা আমার মাথায় এসেছে আমি যখন ছাত্র তখন থেকেই। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্টে লেখাপড়া করেছি। ম্যানেজমেন্টে পড়ার সময়ই আমি চিন্তা করি আমি ব্যবসা করব, ব্যবসায়ী হব। তবে আমার বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। তিনি চাননি যে আমি ব্যবসা করি। তার চাওয়া ছিল পড়াশোনা শেষ করে আমিও সরকারি চাকরি করব। কিন্তু সেটা আর হয়নি, আমি ব্যবসায়ী হয়েছি। তবে আমার বাবা আমাকে অনেকবার বলেছেন সরকারি চাকরি করার জন্য, এমনকি অনেক চাপও দিয়েছিলেন। পরে অবশ্য বাবাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি আমি ব্যবসা করব এবং ব্যবসায় আমি ভালো কিছু করতে পারব। একটা পর্যায়ে এসে যখন তিনি দেখলেন আমি ব্যবসায় ভালো করছি, তখন আবার আমার ব্যবসার প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন এবং তিনি জীবিত থাকাকালেই আমার ব্যবসার সাফল্য দেখে গেছেন। বাবা আমার জন্য অনেক দোয়াও করেছেন যাতে ব্যবসায় আমি সফল হই।
চেয়ারম্যান : হাফিজুর রহমান খান
জন্ম : ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫
জন্মস্থান : নওগাঁ
লেখাপড়া : ম্যানেজমেন্ট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
চাকরিজীবন : ১৯৭৮-৮৩
ব্যবসা শুরু : ১৯৮৩ সাল
ব্যবসা শুরুকালীন পুঁজি : ২০ হাজার টাকা
পুরস্কার ও অর্জন : বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড-২০১৬ ও সিআইপি কার্ড অর্জন-২০১৩-১৪
সন্তান : এক ছেলে ও এক মেয়ে
রানার গ্রুপ প্রতিষ্ঠা : ২০০০ সালে
বর্তমানে রানার গ্রুপের প্রতিষ্ঠান : রানার অটোমোবাইল লিমিটেড, রানার মোটরস লিমিটেড, রানার ব্রিকস লিমিটেড, রানার প্রপার্টিজ লিমিটেড, রানার ওয়েল অ্যান্ড গ্যাস লিমিটেড এবং রানার লুব অ্যান্ড এনার্জি লিমিটেড।
রানার গ্রুপে কর্মরত : ৩ হাজার কর্র্মী
রানার গ্রুপের বর্তমান সম্পদ : ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা
প্রধান কার্যালয় : ১৩৮/১, তেজগাঁও শিল্প এলাকা
এসএম আলমগীর : মোটরসাইকেল বা অটোমোবাইল খাতের ব্যবসায় আসার কারণও কি চাকরির অভিজ্ঞতা, নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?
হাফিজুর রহমান খান : না; আসলে বিষয়টি তেমন নয়। তবে শ্যালো মেশিনের ব্যবসা করার সময় পরিচয় হয়েছিল হোন্ডা কোম্পানির লোকদের সঙ্গে। তারা তখন আমাকে বলে, মোটরসাইকেল দিলে আমি বিক্রি করতে পারব কি না। আমি তাদের জানালাম, আমি পারব। পরে হোন্ডা কোম্পানি আমাকে মোটরসাইকেল দিল এবং আমি বিক্রি শুরু করি। এভাবেই আমি মোটরসাইকেল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়। এরপর ২০০০ সালে রানার প্রতিষ্ঠান করে দেশেই মোটরসাইকেল তৈরি শুরু করলাম।
এসএম আলমগীর : রানার গ্রুপের তো ইটের ব্যবসাও রয়েছে। এ ব্যবসার সঙ্গে কীভাবে জড়ালেন?
হাফিজুর রহমান খান : আসলে আমি শুরু থেকে যে ব্যবসা করেছি সেগুলো সবই বিদেশ থেকে সরঞ্জাম বা পার্টস এনে অ্যাসেম্বল করে বিক্রি করেছি। কিন্তু দেশীয় কোনো পণ্য দিয়ে ব্যবসা করা হয়নি। পরে আমি ভাবলাম দেশীয় উপাদন দিয়ে কি ব্যবসা করা যায়। কিন্তু দেশে তো কোনো কাঁচামাল খুঁজে পায় না। একজন বলল, দেশে তো মাটি আছে। মাটি দিয়ে ব্যবসা করা যেতে পারে। পরে ভেবে দেখলাম তাই তো, আমার দেশের মাটি দিয়ে ব্যবসা করা যায়। সে চিন্তা থেকেই আমি ব্রিকফিল্ডের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়। এ ব্যবসায় খুব বেশি পুঁজি লাগেনি তখন, অল্প পুঁজিতেই এ ব্যবসা শুরু করি। এভাবেই একটা থেকে আরেক ব্যবসায় আমরা যুক্ত হয়েছি।
এসএম আলমগীর : ১৯৮৩ সালে যখন আপনি ব্যবসা শুরু করেন, তখন কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে আপনাকে পড়তে হয়েছে?
হাফিজুর রহমান খান : সব ব্যবসায়ীই, বিশেষ করে নতুন উদ্যোক্তাদের শুরুতেই একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়, সেটি হলো পুঁজির অভাব বা টাকার অভাব। সবাইকে ব্যবসার শুরুতে প্রধান এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে। এ জন্য যারা নতুন এন্ট্রাপ্রেনার তাদের আমি সবসময় বলি, একজন ভালো উদ্যোক্তা ব্যবসা করতে যে পুঁজি লাগে তা জোগাড় করতেও জানে। যার এই গুণটা আছে, সে একজন সফল ব্যবসায়ী হতে পারবে। টাকা ম্যানেজ করতে জানতে হবে। ব্যবসা করতে যে পুঁজি লাগবে সেটি কি পরিবার থেকে দেবে, আত্মীয়-স্বজন দেবে নাকি বন্ধু-বান্ধব দেবে সেটি কিন্তু তাকেই কৌশলে ম্যানেজ করতে হবে। তবে হ্যাঁ যার কাছ থেকেই টাকা নেওয়া হোক না কেন সময়মতো সে টাকা তাকে ফেরত দিতে হবে। আমি আমার ব্যবসার ক্ষেত্রে সবসময় এই নীতি মেনে চলি। আমি যখন যেখান থেকে টাকা নিয়েছি সেগুলো সময়মতো ফেরত দিয়েছি। কেউ বলতে পারবে না যে, আমাদের কাছে কেউ টাকা পায়। ব্যাংক হোক বা অন্য কোনো উৎস থেকে হোক যেখান থেকেই আমরা টাকা নিয়েছি, সেগুলো তাদের লভ্যাংশসহ ফেরত দিয়েছি। মূলকথা হলো, মানুষ যে পেশাতেই যাক না কেন, সাফল্য এমনি এমনিতেই ঘরে আসবে না। পরিশ্রম, মেধা এবং ধৈর্য ছাড়া সফল হওয়া যায় না। সাফল্য আনতে হলে এ বিষয়গুলো সব পেশার ক্ষেত্রেই দরকার। তা ছাড়া সঠিক পরিকল্পনা দরকার এবং সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সঠিক পদক্ষেপ দরকার।
এসএম আলমগীর : আপনার যেহেতু ব্যবসার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, তাহলে শুরুতে আপনি যেসব প্রোডাক্ট বিক্রি করতেন তখন কীভাবে করতেন বা সে সময় কেমন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছেন?
হাফিজুর রহমান খান : শুরুতেই বলেছি, আমি শ্যালো মেশিন বিক্রির মাধ্যমে আমার ব্যবসা শুরু করি। এই পণ্য বিক্রির জন্য দেশের উত্তরাঞ্চলের গ্রামে গ্রামে আমি ঘুরেছি। তখন তো গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভালো ছিল না। মোটরসাইকেলে চড়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে পণ্য বিক্রি করেছি। শ্যালো মেশিনের মূল ক্রেতা হলো কৃষক। আমি কৃষকের ঘরে ঘরে গিয়েছি। তাদের বোঝাতে হয়েছে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মেশিন কেনা যাবে। তখন যথেষ্ট পরিশ্রমের কাজ ছিল পণ্য বিক্রি করা। দিনাজপুর, রংপুর, নওগাঁসহ পুরো রাজশাহী অঞ্চলে আমি শ্যালো মেশিন বিক্রি করেছি। সে সময় আমরা তিনজন পার্টনার ছিলাম, তিনজই পুরো রাজশাহী চষে বেড়িয়েছি শ্যালো মেশিন বিক্রির জন্য।
এসএম আলমগীর : আপনি বললেন, তিনজন মিলে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তিনজন কত দিন একত্রে ব্যবসা করলেন, আলাদা হলেন কখন, কীভাবে?
হাফিজুর রহমান খান : আসলে তিনজন একত্রে পথচলা বেশি দিন টেকেনি, খুব তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে যায়। শ্যালো মেশিনের ব্যবসার সময় আমরা তিনজন ছিলাম। পরে যখন মোটরসাইকেল ব্যবসায় নামি তখন পার্টনার বদল হয়। চলার পথে বিভিন্ন সময় পার্টনারশিপ বদল হয়েছে। তারপর রানার যখন প্রতিষ্ঠা করলাম, তখন আবারও পার্টনার বদল করি। আসলে চলার পথে অনেক সময় অনেক কিছুই বদলাতে হয়।
এসএম আলমগীর : শ্যালো মেশিন বিক্রির ব্যবসা থেকে মোটরসাইকেল ব্যবসায় আসার পেছনে কারণ কী?
হাফিজুর রহমান খান : আসলে অন্য কোনো চিন্তা থেকে মোটরসাইকেল ব্যবসায় আসা হয়েছে বিষয়টি তেমন নয়। শ্যালো মেশিন বিক্রির এক পর্যায়ে আমরা হোন্ডা কোম্পানির কাছে শ্যালো মেশিনের ইঞ্জিন সাপ্লাইয়ের অনুরোধ করি। হোন্ডা কর্তৃপক্ষ তখন আমাদের বলল, আমাদের কাছে কিছু মোটরসাইকেল আছে, নেব নাকি। তখন তাদের কাছ থেকে হোন্ডা মোটরসাইকেল নিয়ে বিক্রি শুরু করি। এরপর হোন্ডার পাশাপাশি ভারত থেকে ভেসপা এনে বিক্রি শুরু করি। এভাবেই মোটরসাইকেল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়।
এসএম আলমগীর : নিজস্ব মোটরসাইকেল কারখানা স্থাপনের চিন্তা কীভাবে এলো?
হাফিজুর রহমান খান : যখন আমদানি করা মোটরসাইকেলের বিক্রির হার বাড়তে লাগল তখন আমার কাছে মনে হয়েছে মোটরসাইকেল আমাদের দেশে তৈরি করা উচিত। এর উদ্দেশ্য ছিল মোটরসাইকেলের দাম কমানো, দেশের মানুষ যাতে কম মূল্য মোটরসাইকেল কিনতে পারে। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আমি কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিই। কারখানা স্থাপনের সময় আমি হোন্ডা কোম্পানির বিশেষজ্ঞদের সাপোর্ট নিই। পরে চায়না একটি কোম্পানি আমাদের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ দেখাল, তাদের নিয়েই শুরু করলাম। আমরা ২০০৬ সালে মোটরসাইকেল কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা করি, ২০০৭ সাল থেকে চেসিস তৈরি করি। আর ২০১১ সালে সম্পূর্ণ মোটরসাইকেল তৈরির কারখানা চালু করা হয় এবং পুরোদমে সম্পূর্ণ মোটরসাইকেল উৎপাদনে যাই আমরা।
এসএম আলমগীর: বর্তমানে আপনাদের কারখানায় মোটরসাইকেল উৎপাদনের অবস্থা কেমন?
হাফিজুর রহমান খান : রানারের কারখানায় বছরে এক লাখ মোটরসাইকেল উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু আমরা পুরোটা উৎপাদন করছি না, অর্থাৎ এক লাখের নিচে আমরা মোটরসাইকেল উৎপাদন করছি। তবে বছরে বছরে আমরা চাহিদামাফিক উৎপাদন বাড়াচ্ছি। আশা করছি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কারখানার সামর্থ্যরে পুরোটাই উৎপাদন করতে পারব।
এসএম আলমগীর : বর্তমানে ঢাকা শহরে অ্যাপসভিক্তিক সার্ভিস পাঠাও আসায় মোটরসাইকেলের চাহিদা বেড়েছে। আপনি কি মনে করেন, এর মাধ্যমে মোটরসাইকেল শিল্পের আরও বিকাশ ঘটবে?
হাফিজুর রহমান খান : আসলে পাঠাও আসায় মোটরসাইকেলের বাজার একদিকে বেড়েছে, আবার কমেছেও। পাঠাও চালকদের কারণে মোটরসাইকেল বিক্রি কিছুটা বেড়েছে। অন্যদিকে যারা মোটরসাইকেল কিনত, তারা তো ভাবছে কেনার কি দরকার। যেখানে যাবে সেখানে পাঠাও বা উবারে গেলেই তো হয়। এখন সাধারণ মানুষ অনেকেই এ ধরনের চিন্তা করছে, ফলে সাধারণ ক্রেতা কমেছে। তারপরও কিন্তু মোটরসাইকেল বিক্রির গ্রোথ বেড়েছে। এর কারণ দেশের অর্থনীতি বাড়ছে, মানুষে মুভমেন্ট বাড়ছে।
এসএম আলমগীর : বাংলাদেশের মোটরসাইকেলের চাহিদা কি বিশ^বাজারে আছে, আপনারা তো রফতানিও করছেন?
হাফিজুর রহমান খান : আমরা ইতোমধ্যেই নেপাল এবং ভুটানে রানার মোটরসাইকেল রফতানি করেছি। আফ্রিকান দেশগুলোতে রফতানির চেষ্টা চলছে। আসলে আমাদের দেশের চাহিদা আর অন্য দেশের চাহিদার মধ্যে তফাত আছে। যেমন শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এসব দেশে ভেসপার চাহিদা বেশি। অথচ আমাদের দেশের মানুষ মনে করে ভেসপা মেয়েদের মোটরসাইকেল। নেপালে আমরা যেসব মোটরসাইকেল রফতানি করছি সেগুলোর মধ্যে বেশি স্পোর্টস বাইক। তারা বলছে আমাদের দেশে পাহাড় বেশি, তাই স্পোর্টস বাইক দিতে হবে। তাদের চাহিদামতো আমরা সেটিই বানাচ্ছি এবং রফতানি করছি। অথচ আমাদের দেশে এ রকম মোটরবাইক আমরা একটিও বিক্রি করতে পারিনি। আবার নাইজেরিয়ার জন্য আমরা একটি নতুন মডেল আনছি। তারা লম্বা সিটের মোটরসাইকেল চাচ্ছে, যাতে তিনজন করে বসতে পারে। সুতরাং আমরা বাজারভেদে চাহিদামাফিক মোটরসাইকেল রফতানি করছি। গত বছর থেকে এ পর্যন্ত আমরা নেপাল আর ভুটানে প্রায় ১ হাজারের মতো মোটরসাইকেল রফতানি করেছি। এ বছরের মধ্যে (২০১৯-২০ অর্থবছরে) শুধু নেপালেই আরও দেড় হাজার মোটরসাইকেল রফতানি করার পরিকল্পনা নিয়েছি।
এসএম আলমগীর : মোটরসাইকেলের বাইরে রানার গ্রুপ তো আরও অন্য পণ্য বিক্রি করছে?
হাফিজুর রহমান খান : হ্যাঁ, মোটরসাইকেলের বাইরে আমরা কমার্শিয়াল ভেহিক্যাল বা বাণিজ্যিক বাহন বিক্রি করি। বেশিরভাগই আমরা ডিলারশিপ নিয়ে এসব পণ্য বিক্রি করি। থ্রি হুইলার এলপিজি বিক্রি করি। ভারতের ভলভো আইশার সোল এজেন্ট আমরা। ভারত থেকে সার্ভো লুব্রিকেটিং অয়েল এনে আমরা বিক্রি করি। তা ছাড়া রানারের রিয়েল এস্টেট কোম্পানিও আছে, যার মাধ্যমে কমার্শিয়াল স্পেস বেশি বিক্রি করা হয়। কালিয়াকৈরে আমাদের ব্রিক ফ্যাক্টরি আছে।
এসএম আলমগীর : এর বাইরে রানার গ্রুপ আগামীতে নতুন আর কী পণ্য বাজারে আনতে যাচ্ছে?
হাফিজুর রহমান খান : আমরা এলপিজি প্লান্ট স্থাপন করছি মোংলায়। আমরা আগামীতে জুতা তৈরির কারখানা স্থাপন করব। এসব এখনও উৎপাদনে যাইনি, পরীক্ষামূলকভাবে কাজ চলছে এখন।
এসএম আলমগীর : আপনি একজন সফল ব্যবসায়ী। আপনার কাছে সাফল্যের মূল চাবিকাঠি কী বা সফল হতে হলে কী করতে হবে?
হাফিজুর রহমান খান : সফল ব্যবসায়ী হতে হলে তো একটি বিষয় দরকার হয় না, অনেকগুলো বিষয় জড়িত। সফল ব্যবসায়ী সেই হতে পারবে, যে ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। এই গুণটা থাকা দরকার। একজন ব্যবসায়ী যে পণ্য বিক্রি করবে, সেটি সে কিনে আনবে বা কারখানায় তৈরি করবে এর সব কিছুই কিন্তু আগামীতে ঘটবে। এর জন্য একটি পরিকল্পনা করতে হবে। আর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে ভবিষ্যতে। সুতরাং যে যত ভালোভাবে তার ভবিষ্যৎ দেখতে পারবে, সে ব্যবসায়ী তত সফল হতে পারবে এবং সে তার পরিকল্পনাটা তত সফলভাবে করতে পারবে। তারপর দরকার পরিকল্পনাকে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা। আপনি পরিকল্পনা করলেন, কিন্তু তার সঠিক বাস্তবায়ন করতে পারলেন না, তা হলে তো সফল হওয়া যাবে না। আমাদের দেশের নতুন ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগেরই পরিকল্পনায় ও বাস্তবায়নে ত্রুটি থাকে। এই দুটি জায়গায় ত্রুটি থাকলেই সফল হওয়া কঠিন হবে। তা ছাড়া যে ব্যবসা করবে সে ব্যবসা সম্পর্কে অতীতের ডাটা বা তথ্য সম্পর্কে ভালো জ্ঞান অর্জন করতে হবে। যার যত সঠিক ডাটা জানা থাকবে, সে তত সফল হবে ব্যবসায়। এর সঙ্গে নিজের মেধা-শ্রম তো আছেই। গত ১০ বছরে ব্যবসায় কী হয়েছে তার সঠিক ডাটা জানার জন্য তো আপনার সঠিক মেধা থাকতে হবে। সুতরাং পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের পাশাপাশি মেধা ও শ্রম দিতে হবে সফল ব্যবসায়ী হতে হলে।
এসএম আলমগীর : ব্যবসায় অনেক উত্থান-পতন থাকে। চলার পথে অনেক সময় অনেক চ্যালেঞ্জ আসে। সে সময় পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করেন?
হাফিজুর রহমান খান : আসলে ব্যবসায় চ্যালেঞ্জ থাকবেই। আমার জীবনেও বিভিন্ন সময় অনেক চ্যালেঞ্জ এসেছে। আমার সামনে যখন যে চ্যালেঞ্জ এসেছে, তখন সে সময়ের পরিস্থিতি বুঝে ঠান্ডা মাথায় সেটি মোকাবেলা করেছি। যেমন অনেক সময় বিক্রিতে চরম ভাটা পড়ে। ২০১১ সালে আমাদের মোটরসাইকেল বিক্রি যা ছিল ২০১২ সালে অর্ধেকে নেমে আসে। তখন একটা বিগ চ্যালেঞ্জ তৈরি হলো আমাদের সামনে। কর্মীদের বেতন দেওয়াটাই কঠিন হয়ে পড়েছিল। তখন সে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে যা করণীয় ছিল সেগুলো আমরা সঠিকভাবে নিয়েছিলাম বিধায় সে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ হতে পেরেছিলাম। মোদ্দাকথা হলো, ব্যবসায় খারাপ সময় আসবেই, কিন্তু তখন হতাশ না হয়ে ধৈর্য ধারণ করে পরিস্থিতি মোকাবেলা করাই বুদ্ধিমান ব্যবসায়ীর কাজ। কেউ যদি বলে, আমার ব্যবসায় সবসময় ভালো যাচ্ছে তাহলে সে সঠিক বলবে না। ব্যবসার নেচারটাই এমন ভালো দিন, মন্দ দিন থাকবেই।
এসএম আলমগীর : আপনারা যারা ব্যবসায়ী, তারা কি শুধু নিজের জন্যই ব্যবসা করেন, নাকি দেশ ও দেশের মানুষে কল্যাণের জন্য ব্যবসা করেন। আপনাদের ব্যবসার থিমটা কী থাকে?
হাফিজুর রহমান খান : আসলে সত্য বলতে কি, ব্যবসা যখন আমি শুরু করি তখন শুধু নিজের চিন্তা থেকেই করি। কীভাবে আমার সংসার চলবে, কীভাবে পেট চলবে এ চিন্তাই তখন মাথায় ছিল। তবে একটা পর্যায়ে এসে কিন্তু দেশ ও দেশের মানুষের চিন্তা অবশ্যই আসে। আমার ওপর কর্তব্য এসেছে দেশের সেবা করার। সে চিন্তা থেকেই আমাদের কোম্পানি সিএসআর কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। শিক্ষা এবং খেলাধুলায় আমরা অনেক সিএসআর কার্যক্রম পরিচালনা করি। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমরা গড়ে দিয়েছি। খেলাধুলায় আমরা টেবিল টেনিস, লন টেনিস, গলফ এবং ক্রিকেটে আমরা অনেক স্পন্সর করেছি।
এসএম আলমগীর: আপনি বলেছেন, মাত্র ২০ হাজার টাকা দিয়ে আপনি ব্যবসা শুরু করেছিলেন। সেখান থেকে আজ আপনার প্রতিষ্ঠানের অবস্থান কেমন?
হাফিজুর রহমান খান : আমার কোম্পানি এখন আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে নেই। ব্যবসাটা এখন জনগণের সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। রানার গ্রুপ এখন লিমিটেড এবং পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি। বর্তমানে এই কোম্পানির প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। এই কোম্পানি এখন দেশ ও দেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।
এসএম আলমগীর : ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
হাফিজুর রহমান খান : আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।