চট্টগ্রাম সমিতির একাউন্ট থেকে সভাপতির বউয়ের একাউন্টে ৪২ হাজার ডলার টান্সফার!

সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

 

 

৮০৮ বার দেখা হয়েছে

চট্টগ্রাম সমিতির একাউন্ট থেকে সভাপতি আবদুল হাই জিয়ার স্ত্রী সাঈদা হাইয়ের একাউন্টে ৪২ হাজার ৮৭৩.০৮  ডলার টান্সফার করা হয়েছে। ঘটনাটি জানাজানি হলে পরে তা আবার ফেরত দেয়া হয়েছে।

কমিটির প্রভাবশালী সদস্য ট্রাষ্ট্রি বোর্ডের চেয়ারম্যান মো: হানিফকে চেয়ারম্যান পদ থেকে বাদ দিলে সমিতির একটি বৃহৎ অংশের কর্মকর্তাদের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।

এ দিকে চিটাগাং এসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকার  কমিটির মেয়াদ দুই বছর পেরিয়ে গেলেও নতুন নির্বাচন দিতে গড়িমসি করছে বর্তমান কমিটি। ২০১৭ সালের এপ্রিলে বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে আবদুল হাই জিয়ার কমিটির সভাপতি দায়িত্ব প্রাপ্ত হয় এবং কার্যকরী কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে। কিন্তু তারা অবৈধ ভাবে এক বছরের বেশী সময় ধরে বহাল তবিয়তে ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। এ নিয়ে সমিতির সাবেক নেতা এবং সমিতির সাধারন সদস্যদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। ১৫ আগষ্ট সমিতির বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের  নিয়ে চট্টগ্রাম সমিতিকে অবৈধ কমিটির হাত কিভাবে রক্ষা করা যায় এ নিয়ে জ্যামাইকার সাটফিন পার্কে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায়  ১১ সদস্য সমাধান কমিটি গঠন করা হয়।

এরই পেক্ষিত বর্তমান কমিটি আবদুল হাই জিয়ার নেতৃত্বে ৪ সেপ্টম্বর সমিতির কার্যলয়ে একটি সভা করেন। সভায় পাঁচ সদস্য নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। এরা হলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার শাহজাহান মাহমুদ, কমিশনার মুজিবুল হক, রতন চৌধুরি, জসিম উদ্দিন, জয়নাল আবেদীন। তবে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে কিনা অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন। এর আগে ২৩ আগষ্ট ট্রাষ্ট্রি বোর্ডের চেয়ারম্যান মোঃ হানিফকে চেয়ারম্যান পদ থেকে কোন নোটিশ ছাড়াই সংগঠন থেকে অব্যাহতি দেন। অব্যাহতি পাওয়ার পরপরই মোঃ হানিফ আবদুল হাই জিয়ার বিরুদ্ধে জালিয়াতির সব বিষয় গুলো উপস্থাপন করেন। মোঃ হানিফ জানান, সভাপতি জিয়ার অপকর্মের প্রতিবাদ কারায় আমাদের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।

বর্তমান কার্যকরী পরিষদের ১৯ সদস্যর মধ্যে ১১ জনই পদত্যাগ করেছেন। বাকি দশ জনের মধ্যে একজন হয়েছেন বহিস্কার, দুইজন থাকেন বাফেলো এবং আরেক সদস্য  চলে গেছেন বাংলাদেশে। এগার সদস্য উপদেষ্টা ও অপর সম পরিমান সদস্য ট্রাষ্ট্রি বোর্ডের সদস্যরাদেরও কোন কার্যক্রম নেই। বর্তমানে ৬  সদস্য বিশিষ্ঠ কার্যকরী কমিটি নিয়ে চলছে চট্টগ্রাম সমিতি।

পদত্যাগকারী সাধারন সম্পাদক মোঃ সেলিম জানান, আমরা দায়িত্ব নেয়ার কয়েক মাস পর ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সমিতির আগের কমিটির কিছু অনিয়ম দূর্নীতির তদন্ত করতে সভা আহবান করা হয়। একই সভায় সমিতির ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান কে হবেন তা নিয়েও আলোচনা করা হয়। কিন্তু কার্যকরী কমিটির সভাপতি আবদুল হাই জিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ কার্যকরী কমিটির কথা মানতে নারাজ। এবং জিয়া প্রভাব খাটিয়ে অনিয়ম দূর্নীতিবাজদের পক্ষ নেন। তাই সমিতির কার্যকরী কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ ১১ সদস্য পদত্যাগ করেন। তখন পদত্যাগ না করে অন্য কোন উপায়ও ছিলনা। কারন আমরা যদি পদত্যাগ না করি তাহলে সমিতির মধ্যে চরম বিশৃংখলা সৃষ্টি হতো। মারামারি হতো। এতে করে সমিতির সুনাম ক্ষুন্ন হতো। তাই আমরা সেচ্চায় পদত্যাগ করি। সংখ্যাগরিষ্ঠ কার্যকরী কমিটি সদস্য পদত্যাগ করায় কার্যকরী কমিটির বৈধতা এখন আর নেই। কমিটির মেয়াদও শেষ হয়ে গেলেও জিয়া অবৈধ ভাবে ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন এতদিন। এখন নির্বাচন কমিশন গঠন হয়েছে আমরা চাই একটি সুষ্ঠ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংগঠনটি পুরোনো ঐতিহ্যে ফিরে যাক।

বর্তমান কার্যকরী কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আশরাফ আলী খান লিটন জানান, কার্যকরী কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কয়েকমাস আগে আমরা সাধারন সভা ডেকেছি । করোনার প্রাদুর্ভাবের জন্য এতদিন নির্বাচন প্রক্রিয়া গঠন করা সম্ভব হয়নি। এখন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে আশা করছি একটি সুন্দর ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে বর্তমান নির্বাচন কমিশন কাজ করবে।

কোষাদক্ষ মতিউর রহমান চৌধুরি জানান, সমিতির এখন দুটি একাউন্ট। ১১ জন কার্যকরী সদস্য পদত্যাগ করার পর ঐ একাউন্টটিতে এখন লেনদেন বন্ধ আছে। লেনদেন বন্ধ হওয়া একাউন্টে ৪৮ হাজার একশ ডলার জমা আছে। নতুন একাউন্টে ৭০ হাজার ডলার আছে। তার থেকে ৩ আগষ্ট ২০২০ বিগত তিন বছরের ভবন ট্যাক্সের ২৭ হাজার ডলার দেয়া হয়েছে। বাকি আরো ৪৩ হাজার ডলার একাউন্টে জমা আছে। আমরা চেকের মাধ্যমে সব লেনদেন করছি । নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠন হয়েছে। কমিশন দ্রুত একটি নির্বাচন উপহার দিয়ে সংগঠনের কার্যক্রমে গতি সঞ্চার করবেন।

সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের বলেন, সংবিধান অনুযায়ি ১১ জন সদস্য পদত্যাগ করার পর কার্যকরী কমিটি পরিচালনার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে। তারপরও বর্তমান কমিটি একটি সুষ্ঠ নির্বাচন দেয়ার আশ্বাসে ২০১৮ সালের পিকনিকে আবদুল হাই জিয়াকে আমি সহযোগিতা করেছি। কিন্তু তারা তাদের কথা রাখেনি। অবৈধ ভাবে ক্ষমতা ধরে রেখেছিলো এতদিন। এ ছাড়া ট্রাষ্ট্রি এবং উপদেষ্টা পরিষদের ২২ সদস্যর কার্যক্রমও স্থগিত করে রেখেছে। আমি চাই বর্তমান নির্বাচন কমিশন দ্রুত একটি অবাধ সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিবে।

সমিতির সাবেক ট্রাষ্ট্রি বোর্ডের চেয়ারম্যান মনির আহমেদ বলেন, দীর্ঘদিন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে কার্যক্রম চালিয়েছে বর্তমান কমিটি। নানান অজুহাতে তারা সময় ক্ষেপন করছিল তারা। এখন নির্বাচন কমিশন গঠন হয়েছে। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করছি নির্বাচন কমিশনের কাজ থেকে।

তিনি আরো বলেন, সমিতির অন্য একটি একাউন্ট খোলা হয়েছে। এ বিষয়ে সাধারন সদস্যরা অবগত নেই। কি লেনদেন হচ্ছে এবং কোথায় খরচ করা হচ্ছে সে বিষয়েও কোন ধারনা নেই। এটা একটা পকেট কমিটির মতো। যখন যা ইচ্ছা তাই করছে তারা। সমিতির ভবন ভাড়া থেকে ৭ হাজার ডলার আসে প্রতিমাসে সে ডলারের কোন হিসাব নেই।

এদিকে সমিতির তিন প্রভাবশালী সদস্য সাবেক সভাপতি কাজী আযম, ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান মোঃ হানিফ এবং সমিতির সাবেক ট্রাষ্ট্রি বোর্ড সদস্য শাহজাহান সিরাজীর মতভেদের  কারনে দীর্ঘদিন নির্বাচিন কমিশন গঠন করা যায়নি। এখন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। আশা করছি সুন্দর একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সমিতিতে প্রাণ সঞ্চার হবে।

ট্রাষ্টি বোর্ডের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান মোঃ হানিফ বলেন, আবদুল হাই জিয়া একজন দূর্নীতিবাজ। আমরা তার অপসারনের দাবীতে সোচ্চার ছিলাম সব সময়। সে সমিতির সব ডলার লুটপাট করার প্রক্রিয়ায় ছিলো সময়। এ ছাড়া জিয়ার বিরুদ্ধে ত্রান বিতরনে অনিয়মেরও অভিযোগ রয়েছে। আমি এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় অত্যন্ত ঘৃণ্য প্রক্রিয়া আমাকে চেয়ারম্যানের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আমার অব্যাহতির বিষয়টি সমিতির বৃহৎ অংশ মেনে নেয়নি।

সাবেক সভাপতি কাজী আযম বলেন, যথা সময়ে নির্বাচন হলে আজকের এই অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের সৃষ্টি হতোনা। নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আমি সব সময় তৎপর ছিলাম। এখন নির্বাচন কমিশন গঠন হয়েছে। আশা করছি সমিতির মালিক সমিতির সাধারন সদস্যরা ভোট প্রদানের মাধ্যমে তাদের নেতা নির্বাচিত করবেন।

চট্টগ্রাম সমিতির সভাপতি আবদুল হাই জিয়া বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে স্বীকার করে বলেন, দ্রুত নির্বাচন দিয়ে দায়িত্ব হস্তান্তর করার জন্য আমরা সবসময় কাজ করে আসছিলাম। কিন্তু কোভিট ১৯ এর কারনে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে সময় লেগেছে। এখনি কমিশন গঠন হয়েছে। পরবর্তী সব কার্যক্রম নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে পরিচালিত হবে।

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হয়ে তিনি বলেন, চিটাগাং সমিতির নামে বর্তমান সভাপতি, সেক্রেটারী এবং কোষাদক্ষের নামে নতুন একাউন্ট খোলা হয়েছে এবং চেকের মাধ্যমে সব লেনদেন হচ্ছে। নতুন কমিটি আসলে তাদেরকে সব বুঝিয়ে দেয়া হবে। বউয়ের নামে ডলার টান্সফারের বিষয়টি অস্বীকার করেন।

সমিতির এসব অনিয়ম দূর্নীতি প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মিজানুর রহমান জাহাঙ্গীর বলেন, বিগত কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রাম সমিতিতে দলাদলি, মারামারি এবং মামলা মোকদ্দমার জন্য চট্টগ্রাম সমিতির আগের সুনাম মুখ থুবড়ে পড়েছে। সমিতির অনেক স্বনামধন্য সম্মানিত সদস্য এখন আর সমিতির অনুষ্ঠানে যাওয়া বাদ দিয়েছেন। এ ছাড়া অযোগ্য নেতৃত্বের কারনে সমিতির সামাজিক কার্যক্রমও আগের মত হচ্ছেনা বলে সাধারন সদস্যরা অভিযোগ করেছেন।

সর্বশেষ চিটাগাং সমিতির কোষাদক্ষ মতিউর রহমান জানান, চট্টগ্রাম সমিতির সাবেক কোষাদক্ষ রাশেলের কাছ সমিতির অপর একাউন্টে থাকা ৪৮ হাজার ডলার উদ্ধার করা হয়েছে।

আরো পড়ুন