গল্প : জমে থাকা নীল

মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

 

 

১১১ বার দেখা হয়েছে

হক ফারুক আহমেদ >>

মৃণ্ময়ী! বাহ্, নামটা বেশ সুন্দর তো!

—আমি দেখতেও কিন্তু বেশ সুন্দরী। কী বলেন?

—কোনো মেয়ে এভাবে বলে নাকি?

—আমি বলি, পরশ। ঠিক বললাম তো আপনার নামটা? আমার মাথায় একটু গণ্ডগোল আছে তো তাই।

—নাম ঠিকই বলেছেন। তবে যে জানে তার মাথায় গণ্ডগোল আছে সে আসলে পুরোপুরি সুস্থ। একটু মাথা খারাপের অভিনয় করে শুধু।

—এভাবেও কি কেউ বলে? কষ্ট লাগে না! সত্যি আমার মাথায় একটু সমস্যা আছে।

—আপনি কত দিন হলো আইটি পেশায় আছেন, এই ফার্মেই কি আপনার প্রথম চাকরি?

—ঠিক চাকরির কথা বললে এটাই প্রথম। তার আগে অন্য একটা ফার্মে কিছুদিন কাজ করেছি কাজ শিখতে। আর আপনি?

—আমি এই পেশায় আছি প্রায় চার বছর। আপনার বস মানে আশিক আশরাফ, তিনি আর আমি একসময় একটা ফার্মেই কাজ করতাম। উনি পরে এখানে জয়েন করেন। অফিস শেষে তার সঙ্গে দেখা করতেই মাঝে মাঝে আপনাদের অফিসে আসা হয়।

—আশিক ভাইকে আপনার কথা বলতে শুনেছি কয়েক বার। আপনি তরুণদের মধ্যে ভালো করছেন সেটাও বলেছে।

—তাই নাকি? আপনি কাজ ভালো করেন সেটাও তো আশিক ভাই আমাকে বলল। কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হলে অবশ্যই বলতে পারেন। এই যে আমার কার্ড। এতে মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে।

—ও আচ্ছা। থ্যাংক ইউ। কথা বলতে বলতে আমরা গলির শেষ মাথায় চলে আসলাম। এবার আমাকে আসতে হবে। ভালো থাকবেন।

—প্রথম দিনের পরিচয়ে ভালোই কথা হলো। এত কথা কোনো মেয়ে প্রথম দিনেই একটা ছেলের সঙ্গে বলে না। আপনাকেও ধন্যবাদ।

—ওই যে বললাম, আমার মাথায় একটু সমস্যা আছে। হা হা হা… আসি।

—আবার দেখা হবে।

মৃণ্ময়ী একটা রিকশায় উঠে বাসায় দিকে রওনা করল। আর পরশ ফুটপাথ ধরে হাঁটতে লাগল। প্রতিদিনই অফিস শেষে সে কিছুটা সময় নিজেকে দেয়। কখনো রাস্তা ধরে হাঁটে। মাঝে কোনো একটা চায়ের দোকানে একটু চা খেয়ে নেয়। কখনো বিজ টেকনোর এই অফিসে এসে আশিক আশরাফের সঙ্গে আড্ডা মারে। মোটামুটি এক-দুই ঘণ্টা নিজের মতো করে কাটিয়ে তারপর বাসায় ফেরে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স শেষ করে টেকশোর নামে একটা আইটি ফার্মে কাজ করছে। বাজারে তার কাজের বেশ সুনাম। বেশ ভালো মাইনে পায়। দেখতেও সুপুরুষ, কিন্তু এখনও ব্যাচেলর। অন্যদিকে মৃণ্ময়ী এই পেশায় একেবারেই নতুন। দেখতে অপরূপা। সে-ও একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে আইসিটির ওপর মাস্টার্স শেষ করেছে।

সেদিনের প্রথম পরিচয়ের কয়েকদিন পরের ঘটনা। মৃণ্ময়ীর মোবাইলে একটা কল এলো সন্ধ্যায়। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মোটা গলায় বল, কি বাসায় পৌঁছেছেন ঠিকমতো? মৃণ্ময়ী উত্তর না দিয়ে পরিচয় জানতে চায়? ওপাশ থেকে রহস্য করে জিজ্ঞেস করে, চেষ্টা করে দেখুন তো গলাটা চেনা চেনা মনে হয় কি না?

—আচ্ছা বিপদ তো! আপনাকে চেনার জন্য মাথায় আলাদা একটা চাপ নিতে হবে কেন আমাকে? পরিচয়টা দেবেন নাকি ফোনটা রেখে দেব?

—না না। ফোনটা রাখবেন না। আমি পরশ বলছি। ওরে বাবা, আপনি এত রেগে গেছেন!

—ও সরি আপনি। না আসলে আননোন নম্বর থেকে উল্টাপাল্টা কল করে বিরক্ত করে তো তাই। কিন্তু আপনিই-বা আমার মোবাইল নম্বর কোথায় পেলেন? আমি তো আপনাকে দেইনি।

—আরে ম্যাডাম, একই পেশায় কাজ করলে নম্বর জোগাড় করাটা কি খুব কঠিন কিছু? আপনি কি বাসায় ফিরেছেন?

—সেটা অবশ্য কঠিন কিছু নয়। আমি একটু আগেই বাসায় ফিরলাম। আপনি কীভাবে বুঝলেন আমি বাসায়?

—আমি ফুটপাথ দিয়ে হাঁটার সময় দেখলাম আপনি রিকশা দিয়ে যাচ্ছেন। ওই সময় বাসা ছাড়া অন্য কোথাও তো যাওয়ার কথা নয়।

—আপনি ডাকলেন না কেন? একসঙ্গে চা খাওয়া যেত। একটু আড্ডাও হতো।

—আমি ভাবলাম চলে যাচ্ছেন। এখন ডাকাটা ভালো দেখায় না।

—এত ভাববেন না। বেশি ভাবলে লোকসান। আমার হাতেও সময় ছিল। আসুন কাল সন্ধ্যায় একসঙ্গে চা খাব।

—বাহ! এ তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! ঠিক আছে দেখা হবে কাল।

পরের দিন সন্ধ্যায় অফিস শেষে পরশ আর মৃণ্ময়ী মিলে জম্পেশ আড্ডা দিল। ক্যারিয়ার, অফিসের কাজ, পড়াশোনার বাইরে আরও নানা বিষয়ে। এরপর আড্ডাটা প্রায় প্রতিদিনই হতে লাগল। আড্ডা শেষে পরশ এখন প্রায়ই মৃণ্ময়ীকে তাদের ধানমণ্ডির বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। একদিন পরশ কোনো একটা কারণে মৃণ্ময়ীকে বাসায় পৌঁছে দিতে পারল না। তার মাথায় কেমন যেন দুশ্চিন্তা কাজ করতে লাগল, মৃণ্ময়ী কি ঠিকমতো বাসায় পৌঁছেছে? একটা উৎকণ্ঠা থেকেই মৃণ্ময়ীর মোবাইলে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি বাসায় পৌঁছেছেন?

মৃন্ময়ী উত্তর দেয়, হ্যাঁ, এই তো কিছুক্ষণ আগেই পৌঁছালাম।

—তা বাসায় পৌঁছে আমাকে একটু জানালে কী হতো?

—কেন আমি তো কখনোই জানাই না?

—জানালে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?

—আপনি কি আমার প্রতি কেয়ারিং হয়ে উঠছেন?

—তুমি এত বেশি বোঝ কেন?

—ইতিমধ্যেই আপনি আমাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে ফেলেছেন!

—ও স্যরি। না… যা করেছি ঠিকই করেছি। আরো করব।

—মাথা ঠিক আছে তো তোমার?

—এই যে তুমিও কিন্তু ‘তুমি’ করেই বললে। আরেকবার বলবে? শুনতে ভালো লাগছে।

সেই সন্ধ্যার ফোনালাপ সন্ধ্যাতেই শেষ হলো না। ফোনালাপ চলল সারারাত। যতই কথা বলে যেন আর শেষ হতে চায় না। বোঝার আর বাকি রইল না দুজন দুজনের প্রেমে পড়েছে। ভোরে ঘুমানোর আগে পরশের মোবাইল ফোনে মৃন্ময়ীর মোবাইল থেকে একটা খুদেবার্তা এলো, তাতে লেখা— ‘কথায় কথায় একদিন, চোখে চোখে দ্বিতীয় দিন, প্রেমে পড়তে তিন দিন, আর কাছে আসতে চার দিন।’

তার পরের কয়েকটা দিন হাওয়ার মতো কেটে গেল। পরশ আর মৃন্ময়ীর উন্মাতাল সময় কাটতে লাগল। সন্ধ্যায় অফিস শেষ করেই তারা রিকশায় ঘুরে বেড়ায়। শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। রিকশা ভাড়া করে ঘণ্টা হিসেবে। শহরময় ঘুরতে ঘুরতেই তারা একে অপরের আরও কাছাকাছি চলে আসে। কখনো কখনো আবার সময় কাটায় বিভিন্ন কফিশপে। আলো-আঁধারি ঘেরা ওসব কফিশপে ওদের প্রেম আরো দুরন্ত হয়ে ওঠে। জড়তা ভেঙে হাতের ভেতর ঢুকে যায় হাত, আলতো চুম্বন থেকে ঠোঁটের আগ্রাসী স্পর্শে শরীরে খেলে যায় বিদ্যুৎ। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে ভেসে যায় উষ্ণতার অথৈ সাগরে। খুব কম সময়ের মধ্যেই ঘটে যেতে থাকে ঘটনাগুলো।

সেদিন সন্ধ্যায় পরশ মৃণ্ময়ীদের অফিসের গলির সামনে অপেক্ষা করে থাকে ওর জন্য। অনেকক্ষণ ধরে মৃণ্ময়ীর মোবাইল ফোন বন্ধ। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর পরশ ওদের অফিসে প্রবেশ করে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখে মৃণ্ময়ী নেই। মৃণ্ময়ীর বস আশিক আশরাফকে জিজ্ঞেস করতেই বলে, আরে মৃণ্ময়ী তো অনেকক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছে। ওর বয়ফ্রেন্ড এসেছিল। নাম যেন কী বলল, শিপলু। মৃণ্ময়ী নিজেই পরিচয় করিয়ে দিল ওর বয়ফ্রেন্ড হিসেবে। ওদের নাকি পাঁচ-ছয় বছরের প্রেম। দুই পরিবারই ওদের সম্পর্কের বিষয়টা জানে।

কথাগুলো শুনে যেন পরশের মাথায় বাজ পড়ল। নিজের কানকে ঠিক যেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না। জীবনে প্রথমবারের মতো প্রেমে পড়ল, প্রেমও হলো, কিন্তু পুরোটাই একটা মিথ্যার ওপর ভর দিয়ে? নিজেকে কোনোমতে সামলে আশিক আশরাফের সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা দিল। বলা যায়, আড্ডার ভান করল শুধু। কারণ যতক্ষণ বসা ছিল, ততক্ষণ মাথার ভেতর শুধু ভনভন করেছে মৃণ্ময়ী আর তার বয়ফ্রেন্ড থাকার বিষয়টা। রাতে বাসায় ফিরে কোনোমতে চারটা খেয়েই সারা ঘরে ছটফট করতে থাকে পরশ। এদিকে মৃণ্ময়ীর মোবাইল তখনো বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। মধ্যরাতের পর মৃণ্ময়ীর মোবাইল অন হলো। পরশ ফোন দিতেই ওপাশ থেকে রিসিভ করে মৃণ্ময়ী বেশ মৃদু গলায় বলল, হ্যালো পরশ বলো।

—তোমার না আজকে আমার সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল?

—আমার খুব জরুরি একটা কাজ ছিল। তাই তাড়াতাড়ি চলে আসতে হয়েছে।

—কী এমন জরুরি কাজ ছিল যে একটু জানাতে পারলে না।

—না মানে একটু পারিবারিক।

—পারিবারিক না ব্যক্তিগত। আমি তোমার অফিসে গিয়েছিলাম।

—ও তাই নাকি, কখন?

—তুমি তোমার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার বেশ অনেকটা পরে। তোমার যে বয়ফ্রেন্ড আছে, এটা তো আগে বলোনি? আমার সঙ্গে কয়েকদিনের প্রেম-প্রেম খেলায় মাততে চেয়েছিলে লুকিয়ে লুকিয়ে?

—দেখো পরশ, তুমি মাথা গরম করো না। আমি তোমাকে সব খুলে বলব। তবে এখন না, কাল দেখা হওয়ার পর। প্লিজ লক্ষ্মীটি, আমাকে ভুল বুঝো না। মোবাইলে এখন যত কথাই বলব, ততই তোমার মাথা আরো গরম হবে।

—কী বলবে তুমি? কী বলার আছে তোমার? কয়টা প্রেম করছ? আমার মতো আর কয়জনের সঙ্গে প্রেম-প্রেম খেলছ বলো তো?

—দেখো পরশ সত্যি বলছি, আমি তোমাকে আসল কথাগুলো সব খুলে বলতে চাই। তোমাকে আমার সব কথা বলতে হবে। প্লিজ আমাকে একটু কাল সন্ধ্যায় সরাসরি দেখা করে তারপর কথা বলতে দাও। তোমার সব কনফিউশন দূর হয়ে যাবে। আমাকে একটু বিশ্বাস করো।

—ঠিক আছে।

পরের দিন ঠিক সন্ধ্যায় মৃন্ময়ীর সঙ্গে দেখা করল পরশ। রিকশায় উঠে বসতে না বসতেই পরশের গালে আলতো একটা চুমো খেল মৃণ্ময়ী। তারপর পরশকে বলল, তুমি কি অনেক রেগে আছ আমার ওপর?

—সেটাই কি স্বাভাবিক নয়। আগে বলো, তোমার কাহিনি বলো। আমার কাছে কী কী লুকিয়েছ সব বলো।

—বলছি তোমাকে সব বলছি। শিপলুর সঙ্গে আমার প্রেম সেই কলেজ জীবন থেকে। ও তখন সবে বুয়েটে ঢুকল। ভালো ছাত্র, দেখতে স্মার্ট। আমাদের পাশাপাশি বাসা ছিল। আসা-যাওয়ার পথেই ওর সঙ্গে দেখা হতো। একটা সময়ে ও আমাদের বাসায় এলো আমার অঙ্কের টিচার হয়ে। তারপর একটু একটু করে চেনা-জানা। ভালো লাগা শুরু করল দুজনার মধ্যেই। ও-ই প্রথম আমাকে প্রপোজ করল। আমিও সাড়া দিলাম। দুই পরিবারে বিষয়টা জানাজানি হলো। সবাই খুশিই হলো বলা যায়। তারপর একসঙ্গে কয়েকটা বছর। জানি না কী এক অজানা কারণে, আমাদের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হতে লাগল। মতের অমিল হতে শুরু করল। আগের মতো ওর জন্য আর টানটা অনুভব হতো না। কথায় কথায় আমরা ঝগড়া করতাম। দূরত্ব আরো বাড়তে লাগল। দুই পরিবারেও আমদের এই টানাপড়েনের খবর জানতে পারল। সবাই বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু ঠিক হলো না। একটা সময়ে আমার আর কিছুই ভালো লাগছিল না। তাই ওর সঙ্গে ব্রেকআপ করলাম। আর আমার সেই একাকিত্বের সময়টাতেই তুমি আমার জীবনে এলে। আমার মনে হলো আমি অনেকদিন পর হাসলাম। ভেতর থেকে। মাত্র কয়েক দিনে কী অদ্ভূতভাবে তুমি আমাকে কাছে টেনে নিলে। তোমার চোখ, তোমার হাসি, তোমার হাঁটা-চলা, তোমার দুষ্টুমি, তোমার স্পর্শ—সব আমাকে পাগল করে তুলল। আমি যেন সেই প্রেম খুঁজে পেলাম, যার জন্য মানুষ অপেক্ষা করে চিরকাল।

—খুবই খারাপ কাজ করেছ। একটা ব্রেকআপ করতে না করতেই আরেকটা প্রেমে জড়িয়ে গেছ। আর যাকে জড়িয়েছ সেই ছাগলটা আমি। যার জীবনে এটাই কি না প্রথম প্রেম। উফ কী বোকা আমি! একবারও জানার চেষ্টা করলাম না যে, তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড বা ভালোবাসার মানুষ আছে কি না! তোমার রূপ দেখে সব ভুলে গেলাম। তুমিই-বা কেন একবারও বললে না তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?

—আমি তোমাকে জানাতাম, কিন্তু আরও পরে। সত্যি বলতে আমি তোমাকে কাছে চেয়েছি। তাই তুমি ‘আমার প্রেম ছিল’ এ কথা শুনে দূরে সরে যাও সেটা চাইনি।

—তাহলে কালকে কেন তোমার বয়ফ্রেন্ড তোমার অফিসে এসেছিল? তোমাদের না ব্রেকআপ হয়ে গেছে?

—সত্যি বলছি, আমি জানতাম না শিপলু হুট করেই আমার অফিসে চলে আসবে। লোকলজ্জার ভয়েই আমি অফিসে ওকে এভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। কিন্তু জানো, ও ক্যাফে আর সারা রাস্তায় আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে। আমি ওর সঙ্গে থাকতে চাই না। একদম না।

—তাহলে তুমি কী করবে? আমার সঙ্গে থাকবে? আমিও যদি তোমার সঙ্গে থাকতে না চাই?

—প্লিজ, তুমি আমাকে ছেড়ে যেয়ো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না।

মৃণ্ময়ী এ কথা বলেই পরশকে জড়িয়ে ধরে রিকশায়। আশপাশে অনেকেই চলন্ত রিকশায় এমন দৃশ্যের দিকে তাকায়। তাতে যেন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই দুজনেরই।

এরপর কয়েকদিন পরশ ও মৃণ্ময়ীর কোনো দেখা-সাক্ষাৎ নেই। দুজনেই যার যার কাজ নিয়ে বেশ ব্যস্ত। যা কথা বলার সব মোবাইলেই হয়। একদিন ছুটির বিকেলে মৃণ্ময়ী পরশকে ফোন দিয়ে হাঁপাতে থাকে। এর মধ্যেও কণ্ঠে কিছুটা জোর দিয়ে বলে, পরশ তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে? এখনই উত্তর চাই?

—হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? আমি তো এখনো পুরোপুরি বিয়ের জন্য প্রস্তুত নই।

—এত কিছু বুঝতে চাই না। তুমি আমাকে ভালোবাসো না?

—হ্যাঁ, বাসি তো।

—তাহলে কালকেই আমাদের এনগেজমেন্ট হবে। তুমি সুন্দর দেখে একটা আংটি কিনে নিয়ে আসবে। এলিফেন্ট রোডের কেএফসিতে ঠিক ১২টায় আমি থাকব। কাউকে দরকার নেই। শুধু তুমি আর আমি থাকলেই চলবে। আমরাই আমাদের এনগেজমেন্ট করব। ঠিক আছে?

—আচ্ছা ঠিক আছে।

পরের দিন ঠিক ১২টায় এনগেজমেন্টের জন্য সুন্দর একটা আংটি নিয়ে এলিফেন্ট রোডের কেএফসিতে হাজির হলো পরশ। তার কিছুক্ষণ পরই সেখানে উপস্থিত হলো মৃণ্ময়ী। এসেই জিজ্ঞেস করল, তুমি কি এনগেজমেন্টের আংটি এনেছ?

—তোমাকে বিয়ে করতে আমি প্রস্তুত। সেটা এখন না হোক পরে হলেও করব। তাই এনগেজমেন্টের জন্য একটা আংটি আমি অবশ্যই নিয়ে এসেছি। কেউ জানুক বা না জানুক তুমি তো জানবে, আমরা তো জানব।

—তুমি সত্যি সত্যিই আংটি নিয়ে এসেছ? হয়েছে কি শিপলু গতকাল আমাদের বাসায় এসেছিল। আমার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করল। আর আমিও ওকে সাফ জানিয়ে দিলাম, আমি ওকে বিয়ে করব না। ও বলল, সে আমাকে বিয়ে করবে না। আমার মেজাজটা একেবারে বিগড়ে ছিল।

—তাই বুঝি মেজাজ খারাপ করে আমাকে বলেছ এনগেজমেন্টের আংটি নিয়ে আসতে?

—না না তা হবে কেন? আজকে সত্যিই আমাদের এনগেজমেন্ট হবে। বাহ্ খুব সুন্দর তো আংটিটা! দাও আমাকে পরিয়ে দাও।

পরশ সত্যিই এক বুক ভালোবাসা আর মমতা নিয়ে মৃণ্ময়ীর হাতে আংটিটা পরিয়ে দিল। তার বুকের ভেতরে যেন কেমন একটা দখিনা হাওয়া খেলে যাচ্ছে। মৃণ্ময়ীর চোখে মুখে কেমন যেন একটা দ্বিধা। তবুও ঠোঁটের কোণে একটু হাসি খেলে যায়।

মৃণ্ময়ী বলল, আমার মনটা এখন পাখি হয়ে গেছে। তোমাকে নিয়ে সারাটা দিন ঘুরতে ইচ্ছে করছে। তোমার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করছে। তোমার বাসাটা না ছোট্ট একটা চিলেকোঠায়। চলো সেখানে যাব।

—আরে না না, আমি ব্যাচেলর। চাইলেই বাসায় একটা মেয়েকে নিয়ে যেতে পারি না।

—আরে বুদ্ধু, আমাদের তো এনগেজমেন্ট হয়েই গেছে। মানে আমি তোমার হাফ বউ। তুমি না ফ্ল্যাট বাসার চিলেকোঠায় থাকো। ওখানে কে এত কার খবর রাখে? দারোয়ানকে বলবে, আমার হবু বউ। চলো না।

—তোমার মাথায় আসলেই সমস্যা আছে। ঠিক আছে চলো।

যেমন বলা তেমন কাজ। ঠিকই পরশের চিলেকোঠায় গিয়ে হাজির। কেএফসি থেকে খাবার কিনে নিল যথেষ্ট। সারা দিন ওরা দুজনে হারিয়ে গেল এক অন্য ভুবনে। পৃথিবীর যত সুখ যেন ছোট্ট এই ছিলেকোঠাতেই থমকে গেল। রাশি রাশি হাসি, আর কথার ফুলঝুরি ফুটতে থাকল পড়ন্ত দুপুরের আলোতেই। আর ভেঙে গেল ওদের সব জড়তা। মন ছুঁয়ে, দেহ ছুঁয়ে ওরা একাকার হয়ে গেল। নোনা ঘামে ভাসতে ভাসতেই বুঝে নিল ভালোবাসার রূপ-রস।

এমনিভাবে আরো কয়েকবার পরশের চিলেকোঠায় এলো মৃণ্ময়ী। প্রতিবারই তারা ভেসেছে আনন্দের ভেলায়। সময়টা বেশ ভালোই কাটছিল দুজনের। হঠাৎ অফিসের একটা কাজে দুই সপ্তাহের জন্য পরশকে পাঠানো হয় দেশের বাইরে। অফিসের কাজ আর ব্যস্ততার কারণে মৃণ্ময়ীর সঙ্গে এই সময়টাতে যোগাযোগ কমই হতো। দেশে ফিরেই পরশ মৃণ্ময়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখা করতে চায়। কিন্তু মৃণ্ময়ী তাতে তেমন একটা সায় দেয় না। পরশ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, কেন? তাই সে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হয় না। পরশ অফিস শেষ করে চলে যায় মৃণ্ময়ীর অফিসে। সেখানে গিয়ে জানতে পারে মৃণ্ময়ী চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। আশিক আশরাফ পরশকে একটা বিয়ের কার্ড দেখিয়ে বলে, আসছে শুক্রবার মৃণ্ময়ীর বিয়ে ওর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে। অফিসের সবাইকে দাওয়াত দিয়েছে যাওয়ার জন্য।

পরশ সোজা অফিস থেকে বের হয়ে মৃণ্ময়ীদের বাসার দিকে ছোটে। কিন্তু অর্ধেক পথে গিয়েই আবার রিকশা ঘুরিয়ে নিজের বাসার দিকে চলে যায়। বাসায় পৌঁছেই মৃণ্ময়ীর মোবাইলে একটার পর একটা ফোন দিতে শুরু করে। বেশ কয়েকবার কল করার পর ফোনটা রিসিভ করে মৃণ্ময়ী। ফোন ধরেই বলে, কী হলো পরশ, এতবার ফোন দিচ্ছ কেন?

—তুমি আমাকে বাদ দিয়ে শিমুলকে বিয়ে করছ কীভাবে?

দেখো, আমি আসলে সরি। সবকিছু পারিবারিকভাবে হচ্ছে। আর আমার ও শিমুলের মধ্যে সবকিছু বনিবনা হয়ে গেছে। তুমি জানো ও কত্ত বড় একটা চাকরি পেয়েছে? শুরুতেই বেতন দেড় লাখ টাকা। তার ওপর অন্যান্য সুবিধা তো আছেই। আর ও এখন আমার অনেক কেয়ারও নেয়।

—মৃণ্ময়ী তুমি এতটা নিষ্ঠুর হতে পারো না! তোমার সব দুঃসময়ে আমি পাশে ছিলাম।

—সে জন্য আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। কিন্তু আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না।

—তাহলে তুমি আমার সঙ্গে এনগেজমেন্টের নাটক কেন করলে? তুমি কি ভুলে যাচ্ছ, আমরা একসঙ্গে কতগুলো মধুর সময় কাটিয়েছি? আমাদের মধ্যে কয়েকবার শারীরিক সম্পর্কও হয়েছে?

—পরশ ওগুলো আমার কাছে কিছু না। আজকের যুগে এমনটা হতেই পারে। এটা কোনো ব্যাপার না।

—তুমি কি আমাকে ভালোবাসোনি? সবই কি স্রেফ সময় কাটানো ছিল?

—আমি তোমাকে ভালোবেসেছি, তবে সেটা সেই সময়টুকুর জন্য। আর ভালোবাসলেই যে বিয়ে করতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই?

—তা নেই, কিন্তু হঠাৎ আমাকে ছেড়ে দিয়ে এত অপছন্দের শিপলুকে কেন বিয়ে করছ?

—দেখো, ও অলরেডি অনেক সাকসেসফুল। ওই পর্যায়ে আসতে তোমার আরও অনেক সময় লাগবে। আমার হাতে অত সময় নেই। আমার পরিবারও চাইছে বিয়েটা হোক।

—গণিকারাও কিছু নীতি মেনে চলে। তুমি তো দেখি কোনো কিছুরই ধার ধারো না।

—তোমার যা খুশি বলতে পারো। আমার আর কিছু বলার নেই। আর ফোন না করলে খুশি হব।

—গো টু হেল।

মৃণ্ময়ীর বিয়ের আর কয়েকদিন বাকি। পরশ একা একা বুকে পাথর নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। না পারছে কাউকে বলতে না পারছে সইতে। কাজকর্মেও তেমন একটা মন নেই ওর। এর মধ্যেই ওর ই-মেইলে অপরিচিত একটা আইডি থেকে মেইল এলো। সেটা খুলতেই দেখল মৃণ্ময়ীর সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন কয়েকজনের অন্তরঙ্গ কিছু ছবি। আর তার নিচে তমাল নামে একজন লিখেছে—এই মেয়েটির নাম মৃণ্ময়ী। নিজেকে বেশ সুশিক্ষিত ও উচ্চ পরিবারের বলে দাবি করে। কিন্তু তার সুন্দর চেহারার পেছনে লুকিয়ে আছে একটা কুৎসিত রূপ। নিজের বয়ফ্রেন্ড থাকা সত্ত্বেও অনেক ছেলেকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ঘোরাফেরা, শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন, উপহার নেওয়াই ওর কাজ। অনেক ছেলের সঙ্গেই এমনটা করে এখন সে তার প্রথম বয়ফ্রেন্ডকে বিয়ে করছে।

পরশ লেখাটা পড়ে কিছুক্ষণ হাসল। তারপর মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে এমন একটা ভঙ্গি করে কাজে মন দিল।

কিন্তু না, ভুলে যেতে আপ্রাণ চেষ্টা করেও পরশ মৃণ্ময়ীকে ভুলে যেতে পারল না। ওকে মিস করতে থাকল। কাছে পেতে চাইল। পরশ বুঝতে পারল, একটা জমে থাকা নীল তাকে জড়িয়ে ফেলেছে। যে নীল মাঝেমধ্যেই ওর ভেতর তীব্র হয়ে ওঠে। তখন অথৈ ভাবনার জলে পরশ যেন ভেসে যাওয়ার উপক্রম, সে ভেবে পায় না, এক জীবনে এই মোহজাল ছিন্ন হবে তো!

আরো পড়ুন