বাংলাদেশ হাই কমিশন লন্ডন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালের ঐতিহাসিক যুক্তরাজ্য সফর উদযাপনে গত শুক্রবার এক বিশেষ স্মারক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। প্রথমবারের মতো লন্ডন মিশনে আয়োজিত এ স্মারক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ব্রিটিশ মন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, হাউজ অব লর্ডসের সদস্য ও বিশিষ্ট ব্রিটিশ সাংসদ, রাষ্ট্রদূত, প্রখ্যাত সাংবাদিক ও ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা জাতির পিতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং যুক্তরাজ্যের সরকার ও জনগণ এবং ব্রিটিশ-বাংলাদেশীদের সাথে বঙ্গবন্ধুর গভীর সম্পর্কের কথা স্মরণ করেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ,কে, আবদুল মোমেন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ইউকে ফরেন, কমনওয়েলথ ও ডেভেলপমেন্ট অফিসের (ইউকেএফসিডিও)-’র দক্ষিণ এশিয়া ও কমনওয়েলথ বিষয়ক মন্ত্রী লর্ড তারিক আহমাদ গেস্ট অব অনার এবং ওয়েলসের ফার্স্ট মিনিস্টার মার্ক ড্রেকফোর্ড বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। বিশেষ আলোচনায় অংশ নেন ব্রিটিশ বিরোধী দলীয় নেতা ও লেবার পার্টির প্রধান কীর স্টারমার এমপি, কনজারভেটিভ পার্টির ভাইস চেয়ার মিস নিকি এইকেন এমপি, পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিষয়ক লেবার পার্টির শেডো সেক্রেটারী অফ স্টেট মিস লিসা নন্দী এমপি, ইউকেএফসিডিও’র পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী জয় মরসি এমপি, বাংলাদেশ বিষয়ক ব্রিটিশ সর্বদলীয় সাংসদীয় গ্রুপের ভাইস চেয়ার লর্ড বিলিমোরিয়া, হাউস অফ লর্ডসের বিচার বিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ার লর্ড হাওয়েল, লর্ড রমি রেঞ্জার, কনজারভেটিভ ফ্রেন্ডস অব ইন্ডিয়ার চেয়ার মিস সীমা মালহোত্রা এমপি, যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার মিস গাইত্রী ইসার কুমার, বিশিষ্ট মানবাধিকার আইনজীবী মিসেস শেরি ব্লেয়ার, ব্রিটেনের রাণীর প্রাক্তন সহকারী প্রাইভেট সেক্রেটারী এবং কমনওয়েলথ এন্টারপ্রাইজ এন্ড ইনভেস্টমেন্ট কাউন্সিল (সিডব্লিউইআইসি)-এর চীফ এক্সিকিউিটিভ মিস সামান্থা কোহেন, বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মহিউদ্দিন আহমেদ, বিবিসির সাবেক সাংবাদিক উইলিয়াম ক্রাউলি, যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সুলতান মাহমুদ শরীফ এবং লন্ডন এ্যাসেম্বলীর কনজারভেটিভ সদস্য ও লন্ডন মেয়র পদপ্রার্থী শন বেইলী।
প্রধান অতিথির আলোচনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ,কে, আবদুল মোমেন বলেন, “স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় বঙ্গবন্ধুর লন্ডন সফর এবং তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হীথ ও বিরোধী দলীয় ও লেবার পার্টি প্রধান স্যার উলিয়াম হ্যারল্ড-এর সাথে বৈঠক যুক্তরাজ্য সরকার, কনজারভেটিভ পার্টি, লেবার পার্টি এবং ব্রিটিশ-বাংলাদেশীদের সাথে বঙ্গবন্ধুর গভীর ও সুদীর্ঘ সম্পর্কের স্বাক্ষর বহন করছে। কার্যত: তখনই বঙ্গবন্ধু যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে বিরাজমান গভীর ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মজবুত ভিত্তি স্থাপন করেছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু ও এ্যাডওয়ার্ড হীথের আনুষ্ঠানিক বৈঠকের কথা উল্লেখ করে বলেন, “ওই বৈঠকের ফলশ্রুতিতেই ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে যুক্তরাজ্য পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।”
লর্ড তারিক আহমাদ জাতির পিতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধুমাত্র বাঙ্গালিদেরই আদর্শ ও প্রেরণা নন, তিনি বিশ্বব্যাপী সব স্বাধীকার ও গণতন্ত্রকামী মানুষেরই মহান অনুপ্রেরণা হয়ে আছেন। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি তাঁর লন্ডন সফর ছিলো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তখনই তিনি যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন এবং সেই সম্পর্কেরই সুফল দুই দেশের সরকার ও জনগণ বিগত পাঁচ দশক ধরে উপভোগ করছে।”
লর্ড আহমাদ বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অন্তর্ভূক্তিমূলক আদর্শকে অত্যন্ত প্রেরণাদায়ক উল্লেখ করে বলেন, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য সরকার সবসময় বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের পাশে থাকবে।
হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম তাঁর স্বাগতিক বক্তব্যে জাতির পিতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, “৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে ১০ ডাউন স্ট্রিটে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হীথ ও বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক বৈঠকেই এ্যাডওয়ার্ড হীথ বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাদর অভ্যর্থনা জানান। প্রকৃতপক্ষে ওই বৈঠক ছিলো সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি তৎকালীন কনজারভেটিভ সরকারের কূটনৈতিক স্বীকৃতিরই নিদর্শন এবং যুক্তরাজ্যের সাথে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ সম্পর্কের প্রতিফলন।”
হাইকমিশনার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সাম্প্রতিক এক চিঠির উল্লেখ করে বলেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ওই চিঠিতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও অন্তর্ভূক্তিমূলক আদর্শকে বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের উন্নয়ন ও অগ্রগতির দিক-নির্দেশক বলে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃতে ২০২১ সালে বাংলাদেশকে একটি মধ্য আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলার অগ্রযাত্রায় যুক্তরাজ্য সরকারের অব্যাহত সহযোগিতার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
ব্রিটিশ বিরোধী দলীয় নেতা ও লেবার পার্টির প্রধান কীর স্টারমার এমপি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একজন বিরল নেতা হিসেবে অভিহিত করে বলেন, তিনি তাঁর দেশের মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ চৌদ্দ বছর কারাবাস করাসহ আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। স্টারমার বঙ্গবন্ধু ও স্যার উলিয়াম হ্যারল্ড-এর বৈঠকের কথা উল্লেখ করে বলেন, সেই বৈঠকের মাধ্যমে দুই মহান নেতা যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের যে সুদৃঢ় সম্পর্কের সূচনা করে গেছেন সে সম্পর্কেরই পঞ্চাশ বছর আমরা এ বছর উদযাপন করবো।
আলোচনা অনুষ্ঠানের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ,কে, আবদুল মোমেন ও লর্ড তারিক আহমাদ যৌথভাবে লন্ডন দূতাবাসে ‘‘বঙ্গবন্ধু পাঠাগার” উদ্বোধন করেন। এ সম্পর্কে হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম বলেন, “জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকী ও তাঁর ঐতিহাসিক যুক্তরাজ্য সফরের স্মারক হিসেবে এ পাঠাগার স্থাপন করতে পেরে আমরা গর্বিত। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যারা গবেষণা করবে তাঁদের জন্য পাঠাগারটি খোলা থাকবে।
অনুষ্ঠানে জাতির পিতার ওপর নির্মিত ‘‘বঙ্গবন্ধু ও ব্রিটেন: এ স্পেশাল রিলেশনশীপ” শীর্ষক একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এরপর জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে প্রখ্যাত সরোদ শিল্পী রাজরূপা চৌধুরীর ‘‘বঙ্গবন্ধু দি ব্রেভ হার্ট: এ ভীর রাসা” শীর্ষক সরোদ বাদনের সঙ্গে প্রখ্যাত অভিনেত্রী ও নৃত্য শিল্পী সাদিয়া ইসলাম মৌ ও তাঁর দলের নৃত্যের এক মনোজ্ঞ যুগলবন্দি পরিবেশিত হয়।