বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে বিগত কয়েক বছর ধরে একটি মহামারির আশঙ্কা জানিয়ে বারবার সতর্ক করা হলেও খুব কম দেশই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আর যথাযথ প্রস্তুতির অভাবেই করোনভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় বহু দেশকে বেগ পেতে হচ্ছে।
করোনাভাইরাস মহামারির দ্বিতীয় ধাপে এখন আবারও বহু দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েছে। ভাইরাস পরিবর্তিত হয়ে আরো ছোঁয়াচে হওয়ায় অনেক দেশ নতুন করে লকডাউনসহ কড়াকড়ি আরোপে বাধ্য হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান চলমান মহামারির মধ্যেই ভবিষ্যৎ মহামারি মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে এবং জনস্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
২৪শে ডিসেম্বর, ২০২০ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে বিশ্বজুড়ে প্রায় আট কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়ে সাত লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশেও এ ভাইরাসে ৫ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যু হয়েছে সাত হাজার মানুষের।
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেই বিশ্লেষণ হচ্ছে – কার কী প্রস্তুতি ছিল, সক্ষমতা কী আছে আর ঘাটতি কোথায়। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর স্বাস্থ্য খাতের নানারকম সংকট সামনে আসে। প্রথমদিকে পরীক্ষার জন্য দীর্ঘ লাইন, ফল পেতে ভোগান্তি, হাসপাতালে ভর্তি, আইসিইউ এবং জরুরি অক্সিজেনের ঘাটতি ছাড়াও সাধারণ রোগের চিকিৎসা ব্যহত হয়েছে।
এছাড়া শুরুতে চাহিদার তুলনায় জরুরি সুরক্ষা সামগ্রীর সংকট যেমন দেখা যায় এ নিয়ে বিতর্কের মুখেও পড়তে হয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগকে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী বলছেন, “আমাদের জনস্বাস্থ্য বিভাগটি কোন মহামারি মোকাবেলার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। একেবারেই সামর্থ্যহীন ছিল। কারণ আমরা কাগজেকলমে যে পরিকল্পনা করেছিলাম মহামারি প্রতিরোধের জন্য, এটি যখন বাস্তবায়িত করতে যাই আমরা দেখেছি তার একটি বড় অংশই বাস্তবায়ন করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।”
লেলিন বলছেন, “অতএব বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা করোনা পরবর্তীকালে জনস্বাস্থ্যের ওপরে জোর দিয়ে নতুনভাবে বিন্যাস্ত করতে হবে। এটাই আমাদের জন্য বড় একটা শিক্ষা।”
মহামারি চলাকালীন অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সক্ষমতা বেড়েছে বলেও অনেকের কাছে দৃশ্যমান। পরীক্ষার ল্যাব থেকে শুরু করে করোনার চিকিৎসা, অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা এবং ব্যবস্থাপনায় এ উন্নতির কথা বলছেন আইইডিসিআর’র অন্যতম উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন।
“২৬শে মার্চ পর্যন্ত আরটিপিসিআর পরীক্ষা কেবলমাত্র একটি ল্যবরেটরিতে হতো। এখন প্রায় ১৩০টি ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা হচ্ছে। তাছাড়া আমরা জিন এক্সপার্ট মেশিন দিয়ে কাজ করছি। এবং অ্যান্টিজেন র্যাপিড টেস্টও করছি।”
তিনি বলছেন, “কাজেই সক্ষমতা এটাতো খুবই নাটকীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের বিভিন্ন জেলা শহর হাসপাতালে কিন্তু হাইফ্লো অক্সিজেন যেটা বিরামহীন অক্সিজেন সরবরাহের সক্ষমতা কিন্তু বেড়েছে। আমাদের আইসিইউ ক্যাপাসিটি বেড়েছে। তবে হ্যাঁ, দক্ষ জনবল তৈরিতে আমরা কিছুটা পিছিয়ে আছি। কারণ দক্ষ জনবল এতদ্রুত তৈরি করা যায় না।”
তবে মহামারির মধ্য এই যে স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি বা সক্ষমতার চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে সেটিও যে অপর্যাপ্ত তাতে অনেকের কোন সন্দেহ নেই।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর আগেও পৃথিবীতে মহামারি এসেছে আর ভবিষ্যতেও আসবে এটাও নিশ্চিত। তাই এখন থেকেই বিশ্বকে পরবর্তী মহামারি মোকাবেলায় পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতি নিতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মাহফুজা রিফাত বলেন, “টেস্টিংয়ের কথা যদি আমি বলি, ট্রিটমেন্ট, সাপ্লাই সাইড ডিমান্ড সাইড এবং যোগাযোগ কৌশল এই জায়গাগুলোতে আমাদের দ্রুত বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। ডায়াগনস্টিক যে নতুন প্রযুক্তিগুলো আসছে সেগুলো দ্রুত আনতে হবে। একই সঙ্গে আমাদেরকে অবশ্যই বেসরকারি স্বাস্থ্যখাতকেও এর সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। যেটা এই মহামারির ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে বিলম্ব হয়েছিল।”
তিনি মনে করেন, “প্রথম পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের পিপিই (সুরক্ষা সামগ্রী) সংকট থেকে শুরু করে, প্যানিক, স্টিগমা প্রত্যেকটা জিনিস আমরা দেখেছি এই জিনিসটা যাতে পরবর্তীতে না হয় এগুলোই কিন্তু আমাদের প্রস্তুতির অংশ পরবর্তীতে।”
করোনাভাইরাস মহামারি এখনো শেষ হয়নি। আর এটাই শেষ কোনো মহামারি নয় বলেই বিশেষভাবে সতর্ক করছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। সুতরাং কেবল চিকিৎসা বা হাসপাতাল নির্ভর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মহামারি মোকাবেলায় কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না।
তাই আগামীতে যেকোনো মহামারি মোকাবেলার জন্য জনস্বাস্থ্যকে মাথায় রেখে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন দেখেন বিশেষজ্ঞরা।
ভবিষ্যৎ কী ধরনের প্রস্তুতি থাকা দরকার সে বিষয়ে লেলিন চৌধুরী নিজস্ব সামর্থ্য কাজে লাগানো এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন। লেলিন বলছেন, “যদি নিজে প্রথম ধাক্কাটা সামাল দিতে না পারা যায় তাহলে কিন্তু দাতাসংস্থা বা অন্যদের সাহায্য নিয়ে অনেক বেশি কিছু করে ফেলবে এই ভাবনাটা মনে হয় এখনকার বিশ্বে আর কার্যকরি না।”
“একারণেই এই প্যান্ডেমিক থেকে আমাদের দেশের শিক্ষা হবে নিজের পা’কে শক্তিশালী করা, নিজেদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা এবং নিজের যে সামর্থ্য রয়েছে তার সর্বোত্তম ব্যবহার করা। এটি যেমন গবেষণার ক্ষেত্রে তেমনি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ক্ষেত্রে তেমনি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে।”
এরই মধ্যে করোনাভাইরাস কেড়ে নিয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন। অর্থনীতি, জীবন জীবিকা, ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত। তাই পরবর্তী মহামারি মোকাবেলায় এখন থেকেই প্রস্তুত হবার তাগিদ দিচ্ছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা।
মহামারি বা সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেই আবার উদাসীন হবার যে চক্র তা থেকে বেরিয়ে আসারও পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ কী করছে? রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অন্যতম উপদেষ্টা মুশতাক এ বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। ভবিষ্যৎ মহামারি নিয়ন্ত্রণের বাংলাদেশের প্রস্তুতি এবং পরিকল্পনা কেমন হবে সেটি নির্ধারণে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছেন বলেও জানান তিনি।
“১৯টি ক্ষেত্রে সক্ষমতা হওয়ার কথা। এবং এই করোনা মহামারির সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে এগারটি স্তম্ভ। সেইটাকে ধরে ধরে আমরা আমাদের শক্তির দিকগুলো কোথায়, আমাদের দুর্বলতার দিকগুলো কোথায় এবং এটার কী অভিঘাত হয়েছে আমাদের মহামারিতে।”
তিনি বলছেন, “আমাদের যে শূণ্যস্থানটা আছে সেটা কীভাবে পূরণ করবো এগুলো কিন্তু চিহ্নিত করছি। এগুলো নিয়ে আমরা আশা করি যে আগামী বছরের মধ্যে খসড়া একটা জেনেরিক করছি। আমাদের এখনকার যে অভিজ্ঞতা সে অভিজ্ঞতাকে সামনে নিয়ে। নিশ্চয়ই অতীতে যে ভুলগুলো হয়েছে ভবিষ্যতে সে ভুলগুলো হয়তো হবে না।”
করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিস্কার এবং মানবদেহে প্রয়োগের শুরুকে দেখা হচ্ছে চলমান মহামারির শেষের শুরু হিসেবে। কিন্তু এটাই যে শেষ মহামারি নয় সেটি নিশ্চিত, তাই পরামর্শ হচ্ছে এবারের শিক্ষা থেকে আগামী মহামারি জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নেয়ার।