বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ খুবই কম নম্বর পেয়ে একেবারে শেষের কাতারে থাকা দেশগুলোর জায়গায় স্থান পাওয়ায় শিক্ষাবিদ এবং গবেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। ওই সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার ছ’টি দেশের মধ্যেও বাংলাদেশের অবস্থান সবার শেষে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী এবং মোহাম্মদ বিন রশিদ আল-মাকতুম নলেজ ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম। এবার বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে বাংলাদেশের প্রাপ্ত নম্বর হলো ৩৫.৯, যা বৈশ্বিক গড় নম্বরের চেয়েও অনেক কম।
বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে বাংলাদেশ সবচে খারাপ অবস্থা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৯তম। বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবার নিচে। এছাড়া গবেষণা ও উদ্ভাবনেও পিছিয়ে রয়েছে এদেশ, যেখানে ৯৬ তম অবস্থান বাংলাদেশের।
জ্ঞান সূচকে কেন এতটা পিছিয়ে বাংলাদেশ – এমন এক প্রশ্নে শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, জ্ঞানের যে অনুশীলন তার মূল্য পৃথিবীজুড়েই কমে গেছে। এখন আসছে তথ্যের যুগ। তথ্য আর জ্ঞানতো এক না।
তিনি বলেন, তথ্যের অবাধ প্র্রবাহ জ্ঞানের চর্চাকে খর্ব করছে পৃথিবী জুড়েই। জ্ঞান এখন পুরো পৃথিবীতে পণ্যে পরিণত হয়েছে, কেনা যায়। নিজের অনুশীলন বা গবেষণা দরকার হয় না। এটা কেনা যায়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরো খারাপ।
“আমরা দেখছি যে জ্ঞানের মূল্য এখন সমাজে নেই, রাষ্ট্রে নেই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেখানে জ্ঞানের চর্চা থাকবে সেখানেও আমরা জ্ঞানের মূল্যটা আমরা দিতে পারছি না। প্রতিষ্ঠানের যিনি প্রধান হন, তিনি জ্ঞানানুশীলনের জন্য সেই জায়গায় যান না।
তার যোগ্যতাটা হচ্ছে তিনি দলের সাথে আছেন, রাজনৈতিক আণুকূল্য পাচ্ছেন, তদবীর করছেন… কাজেই তিনি কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন না, অনুপ্রাণিত করতে পারেন না। আবার যারা শিক্ষকতা পেশায় আছেন, এখানে উন্নতি নির্ভর করছে ওই দলীয় আনুগত্যের ওপর। এবং সেজন্য গবেষণাও কমছে, প্রকাশনাও হচ্ছে না।”
এ ব্যাপারে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, “উচ্চমান অর্জনের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি বা শিক্ষকদের গবেষণা, শিক্ষার্থীদের গবেষণাগার, পাঠাগার এগুলো কিন্তু উন্নতমানের থাকতে হয়। এখানেও কিন্তু আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছি”।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার পেছনে রাষ্ট্র ও সমাজে জ্ঞানীদের মূল্যায়ন না থাকার পাশাপাশি জ্ঞান চর্চার অনেক মৌলিক সমস্যারও সমাধান হয়নি।
শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, জ্ঞানচর্চার পরিবেশও বাংলাদেশে স্বাধীন নয়। “জ্ঞানের যে অনুশীলন সেটার সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হলো মাতৃভাষার মাধ্যমে। মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞানের চর্চা না করলে সেই চর্চা গভীর হয় না, স্থায়ী হয় না, প্রভাবশালী হয় না। সেটা আমরা করতে পারি নাই।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা অনুবাদ করতে পারিনি পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানের বই। আমরা নিজেদের ভাষায় পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানকে নিয়ে এসে সেই গ্রন্থ রচনা করতে পারিনি। আমরা সেটা সকলের কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি। কাজেই জ্ঞান কিন্তু একজন দু’জনের ওপর নির্ভর করে না। জ্ঞান নির্ভর করে গোটা সমাজের ওপর। সমাজের যে কাঠামো আছে সেই কাঠামোর ওপর”।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক বলেন, “আরেকটা জিনিস আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে সেটা হলো যে জবাবদিহিতা নেই। রাষ্ট্র থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের অধীনে যত প্রতিষ্ঠান আছে সমাজে যত প্রতিষ্ঠান আছে, কোথাও এখন জবাবদিহিতা নেই। জবাবদিহিতা না থাকলে তো কোনো বিকাশ হয় না। প্রশ্ন করতে হবে, জিজ্ঞাসা করতে হবে, জবাব দিতে হবে এবং প্রশ্ন করার অধিকার দিতে হবে। সেইগুলো তো আমরা দিতে পারছি না”।
বৈশ্বিক জ্ঞান সূচক তৈরিতে প্রাক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, প্রযুক্তি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ, উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও উন্নয়ন, উদ্ধাবনের মতো সাতটি সেক্টরে ১৯৯টি ইন্ডিকেটর বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থায় কতগুলো সমস্যা সামনে আনেন।
তিনি বলেন, “আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বেশকিছু গলদ আছে। ব্যবস্থাপনা আমাদের ভীষণ রকম কেন্দ্রায়িত। সবকিছু সেন্ট্রালাইজড। স্থানীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা শিক্ষাব্যবস্থার কোন খাতের মধ্যেই নেই। দ্বিতীয়ত, এতবড় শিক্ষাব্যবস্থায় যে দক্ষ শিক্ষকের প্রয়োজন, সেই দক্ষ শিক্ষকমণ্ডলীর অভাব আছে। প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার অভাব আছে।”
রাশেদা কে চৌধুরীর মতে, সারা বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রের মধ্যে নানা ধরনের বৈষম্য বিরাজমান। শিক্ষাব্যবস্থায় বহু ধারা উপধারা, মোটাদাগে তিনধারা – মূলধারা, ইংরেজি মাধ্যম এবং ধর্মীয় ধারা এই তিনটির মধ্যে বৈষম্য আছে, বিনিয়োগে বৈষম্য দক্ষতার ক্ষেত্রে বৈষম্য।
“সবকিছু মিলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আসলে তেমনভাবে এগোতে পারছে না গুণগত মানের দিক থেকে”।
বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে তালিকাভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে কাছাকাছি সময়ে স্বাধীন কোরিয়া এবং ভিয়েতনামে রয়েছে দীর্ঘ যুদ্ধের ইতিহাস। এসব দেশের অগ্রগতির পেছনেও একটা বড় কারণ হলো শিক্ষা এবং গবেষণায় বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ।
বাংলাদেশে শিক্ষায় বিনিয়োগ এখনো কাঙ্খিত নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, “ইতিমধ্যে আমাদের যে সকল দেশ আমাদের প্রায় সমান সমান ছিল, যেমন ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, এসব দেশের শিক্ষার্থীরা কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসতো এক সময়। এখন আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা পড়তে যায় সেসব দেশে।
“কেনিয়ার মতো দেশ মোট বাজেটের ৪৫ শতাংশ শিক্ষার জন্য ব্যয় করে। এই প্রাধিকারের জায়গাটা আমাদের এখন পর্যন্ত আমরা ঠিক করতে পারিনি।”
বাংলাদেশে বর্তমানে সাক্ষরতার হার, শিক্ষার্থীর সংখ্যা, প্রাথমিকে ভর্তির মতো সংখ্যাগত দিক থেকে সাফল্য অর্জিত হলেও শিক্ষার মানের ঘাটতি উঠে আসছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গবেষণায়। বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার যে চিত্র, সেটি শিক্ষা ব্যবস্থার সংকটের আরেকটি দৃষ্টান্ত বলেই মনে করেন সবাই। সূত্র: বিবিসি বাংলা