স্বাভাবিক হয়ে আসছে করোনা পরিস্থিতি। বিশ্বব্যাপী খুললেও দেশে এখনও বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মহামারির কারণে দীর্ঘদিন ঘরবন্দি হয়ে মানসিক চাপে পড়েছে শিশু-কিশোররা। কবে আবার আগের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে তা তাদের জানা নেই। প্রয়োজনে বয়স্করা ঘর থেকে বেরুতে পারলেও চার দেওয়ালে বন্দি তারা। এমন অবস্থায় শিশুদের দিকে বিশেষ মনোযোগ ও তাদের হাসিখুশি রাখার উদ্যোগ নিতে অভিভাবকদের প্রতি পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
নরওয়ে, ডেনমার্ক, জাপান, নিউজিল্যান্ডসহ সুইজারল্যান্ডের মত উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে বহু আগেই। ফ্রান্স, স্পেন, রাশিয়া ও ইতালির মত করোনা প্রবণ দেশগুলোও স্কুল খুলে দিয়েছে। যদিও সুইডেন পুরো করোনা সময় কালের মধ্যে স্কুল খোলা রেখেছে। পুরো বিশ্ব যখন লকডাউন তখনও সুইডেনের সব কিছুর পাশাপাশি স্কুলও ছিল খোলা। এমনকি ১৬ বছরের কম বয়সীদের জন্য স্কুলে যাওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। তাদের যুক্তি- শিশুরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে যতটা না ক্ষতিগ্রস্থ হবে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হবে স্কুলে না গেলে।
যুক্তরাজ্যের প্রধান মেডিকেল অ্যাডভাইজার প্রফেসর ক্রিস হুইটির মতো এই মত অনেক বিশেষজ্ঞেরেই।
আমাদের দেশে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভার্চুয়াল ক্লাস চালু করেছে। তবে এটি কতটুকু মানসিক বিকাশে সহায়ক হবে তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দিন যতই যাচ্ছে শিশুরা ততই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাববোধ করছে। কারণ ভার্চুয়াল ক্লাসরুমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের জন্য সহজ নয়। যদিও ভার্চুয়াল ক্লাসে শিক্ষার্থীরা ল্যাপটপ বা কম্পিউটারের মনিটরে তাদের বন্ধুদের দেখার সুযোগ পাচ্ছে কিন্তু সেখানে এই শিক্ষার্থীরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। আবার সব স্কুল অনলাইনে ক্লাস নিতেও পারছে না। অনেক অভিভাবকের পক্ষেও সন্তানকে অনলাইনে ক্লাস করানো সম্ভব হচ্ছে না। কারণ সবার ইন্টারনেট সুবিধা নেই। ঢাকা ছেড়ে ইতিমধ্যে অনেকে পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। সেখানে ইন্টারনেট সুবিধাও নেই। এভাবে শিশুরা পাঠদানের ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে শিশু-কিশোররা নানা রকম মানসিক সমস্যার মধ্যে পড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
প্রফেসর ক্রিস হুইটি বলেন, ‘স্কুলে না গেলে শিশুদের দীর্ঘমেয়াদী যেসব ক্ষতি হয় তা অবাক করার মতো। এর রয়েছে বহু দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি। এটা বৈষম্যের ঝুঁকি বাড়ায়। এমন ক্ষতির শঙ্কা যার শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। স্কুলে না গেলে শিশুরা দীর্ঘমেয়াদে বহু শারীরিক এবং মানসিক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।’
যুক্তরাষ্ট্রে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে- গ্রীষ্মকালীন ছুটির কয়েক সপ্তাহে দেশটির থার্ড গ্রেডের শিক্ষার্থীরা পড়ায় ২০ ভাগ এবং গণিতে ২৭ ভাগ অর্জন খোয়ায়, যা সে এর আগে করেছিল। নবম গ্রেডের শিক্ষার্থীরা খোয়ায় যথাক্রমে ৩৯ ভাগ ও ৫০ ভাগ। গরমের ছুটিতে শিক্ষার্থীদের অর্জনের এই ক্ষতিকে বলা হয় সামার স্লাইড। এ অবস্থায় প্রশ্ন হচ্ছে- গ্রীষ্মের কয়েক দিনের ছুটিতেই যদি এমন অবস্থা হয় তবে এই করোনা মহামারির দীর্ঘ সময়ে দেশের যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে আছে সেখানে কত ক্ষতি হচ্ছে। তারা শুধু শিক্ষার ধারাবাহিকতা থেকেই পিছিয়ে পড়ছে না, তাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, যেহেতু শিক্ষকরা সরাসরি শিশুর কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। এ জন্য অভিভাবকদের শিশুর দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যদিও সার্বক্ষণিক নজরদারির কারণে অভিভাবকদের চাপও বাড়ছে। আগে স্কুলে, পাড়া-মহল্লার খেলার মাঠে কিংবা প্রতিবেশীর বাড়ি গিয়ে একটি শিশু বেশ কিছু সময় কাটানোর সুযোগ পেত। যা এখন সম্ভব নয়। আগের মতো স্বাভাবিকভাবে খেলাধুলা করতে না পেরে এবং অন্য শিশুদের সঙ্গে মিশতে না পেরে শিশুদের মধ্যেও উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘ সময় বাইরে না যাওয়ার ফলে শিশুরা ভয় পেতে পারে, বিরক্ত হতে পারে, রাগ করতে পারে, হতাশ হতে পারে, দুষ্টুমি বেড়ে যেতে পারে। এটা স্বাভাবিক। তাই অযথা বাচ্চাদের বকাঝকা না করার জন্য অভিভাবকদের প্রতি পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম বলেন, ‘এই পরিস্থিতি সামাল দিতে অভিভাবক, শিক্ষক, প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনদের এগিয়ে আসতে হবে। সবাইকে শিশুদের জন্য সময় দিতে হবে। পরিবর্তিত পরিবেশে শিশুদের জন্য যদি বিনোদনের ব্যবস্থা করা যায় এবং তাদের শিক্ষণীয় কিছু শেখানো যায় তাহলে শিশুদের ব্যস্ত রাখা যাবে। এছাড়া শিশুদের মাতিয়ে রাখতে বড়রা ছড়া শেখানো, একসঙ্গে গান করা এবং বিভিন্ন ঘরোয়া খেলার আয়োজন করতে পারেন।’
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এ গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামঞ্চলের শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার সময় কমে গেছে ৮০ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর দে এর সূত্র মতে, দেশের প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীর দৈনিক ১৮ কোটি শিক্ষাঘন্টা নষ্ট হচ্ছে এই বন্ধের কারণে।
আর টিভি, স্মার্টফোন বা ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্ত হয়ে ঘরবন্দী শিশু-কিশোররা যে অপূরণীয় শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তা ইতিমধ্যেই সমাজ বুঝতে শুরু করেছে। শহরের শুশিদের মেদস্থুলতা বেড়ে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগের ঝুঁকি বেড়েছে অনেক। বেড়েছে হতাশা, উদ্বেগ, আত্মহত্যা ও বখে যাওয়ার প্রবণতা। বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রমে, শিশু নির্যাতন ও শিশু-কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা বৃদ্ধিও এই বন্ধের কারণ।
অথচ সমীক্ষায় দেখা গেছে, শিশুরা কোভিড ১৯-এ কম ঝুঁকিপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এক তথ্য অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় স্কুল বয়সী শিশুদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম। আর আক্রান্ত হলেও তাদের মারাত্মক অসুস্থ হতে দেখা যায় না।
এ অবস্থায় স্কুলে যাওয়া মানেই বড় ক্ষতির মুখে ঠেলে দেওয়া নয়, বরং বড় ক্ষতির মুখ থেকেই ফিরিয়ে আনা। এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।