১৫০ মৃত্যু ৩ লাখ গৃহহীন

মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

 

 

১০১ বার দেখা হয়েছে

পাঁচ সহস্রাধিক আহত, চলছে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক
জরুরি অবস্থা ঘোষণা
বিশ্বনেতাদের শোক প্রকাশ, সহযোগিতার আশ্বাস

লেবাননের রাজধানী বৈরুতে মঙ্গলবারের বিস্ফোরণে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় বন্দর ও আশপাশের এলাকা। বিস্ফোরণের জেরে উঁচু এই গুদাম থেকে ছড়িয়ে পড়া খাদ্যশস্য চোখে পড়ে দূর থেকেও। ছবি : এএফপি

লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের জন্য অরক্ষিত অবস্থায় রাসায়নিকের মজুদকে দায়ী করছে সেখানকার সরকার। দেশটির প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন বলেছেন, নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা ছাড়াই একটি গুদামে ছয় বছর ধরে দুই হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বিস্ফোরক ছিল; সেখানেই বিস্ফোরণ ঘটে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর লেবাননের প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব বলেছেন, বিপজ্জনক গুদামে প্রাণঘাতী বিস্ফোরণের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনা হবে।

কৃষিতে সার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য সাধারণত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বৈরুতে ওই রাসায়নিকের গুদামে ঠিক কিভাবে বিস্ফোরণ ঘটে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। তদন্তকারীদের প্রাথমিক ধারণা, ওই গুদাম বা এর আশপাশে লাগা আগুন থেকেই বিস্ফোরণ ঘটেছে।

গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বৈরুত বন্দরে ওই রাসায়নিক গুদামে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ঘটনাস্থলের আশপাশের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে গেছে, ভেঙে পড়েছে বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে অনেক মানুষ। বিস্ফোরণের তীব্রতা এতই ব্যাপক ছিল যে আশপাশের শহর তো বটেই ২৪০ কিলোমিটার দূরের প্রতিবেশী সাইপ্রাসেও কম্পন অনুভূত হয়। ভয়ংকর এই বিস্ফোরণে এরই মধ্যে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় শ। আহত হয়েছে পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ। হতাহতদের মধ্যে চার বাংলাদেশির প্রাণহানি এবং ৯৯ জনের আহত হওয়ার খবর দিয়েছে বাংলাদেশ মিশন। আর আইএসপিআর জানাচ্ছে, বৈরুতে আহতদের মধ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ২১ সদস্য আছেন, যাঁরা সেখানে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে আছেন। নিহতদের স্মরণে লেবাননে গতকাল বুধবার থেকে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক চলছে।

বিস্ফোরণের পর অ্যাম্বুল্যান্সের সাইরেনের শব্দ আর উদ্ধারকর্মীদের ছোটাছুটি শুরু হয় বৈরুতে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে মিলে উদ্ধারকাজে নামে রেড ক্রসের অন্তত ৩০টি দল। হাসপাতালগুলো জানিয়েছে, শয্যার চেয়ে রোগী অনেক বেশি হয়ে গেছে, আহতদের জন্য অনেক রক্ত দরকার।

বিস্ফোরণের পর প্রেসিডেন্ট মিশেল আউনের নেতৃত্বে দেশটির প্রতিরক্ষা পরিষদ জরুরি বৈঠকে বসে। বৈঠক শেষে রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন আউন। একই সঙ্গে তিনি ১০ হাজার কোটি লেবাননি পাউন্ড সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বৈরুতকে দুর্যোগকবলিত শহর হিসেবে ঘোষণা করেছে লেবাননের শীর্ষ প্রতিরক্ষা পরিষদ। এই পরিষদ ঘটনা তদন্তে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে। তদন্তে যারা দোষী সাব্যস্ত হবে, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত লেবানন করোনা মহামারিতে এসে চরম দুঃসময় পার করছে। এর মধ্যে এই ভয়াবহ বিস্ফোরণে চরম অসহায় অবস্থায় পড়েছে সেখানকার মানুষ। এই পরিস্থিতিতে দেশটির পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন বিশ্বনেতারা। লেবাননকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইরান, ইসরায়েল ও নেদারল্যান্ডস। আজ বৃহস্পতিবার লেবানন পরিদর্শনে যাচ্ছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ।

লেবাননের গভর্নর মারওয়ান আবুদ বলেছেন, বিস্ফোরণে বৈরুত শহরের অর্ধেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গৃহহীন হয়ে পড়েছে তিন লাখ মানুষ। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ৩০০ থেকে ৫০০ কোটি ডলার হতে পারে। প্রকৌশলী ও কারিগরি দল ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে কাজ করছে। 

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ২০১৪ সালে একটি জাহাজ থেকে ওই অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট জব্দ করার পর সেগুলো বন্দরের একটি গুদামে রাখা হয়। এর পর থেকে বিপজ্জনক ওই রাসায়নিক সেখানেই পড়ে ছিল।

বিস্ফোরণস্থলের কাছেই ২০০৫ সালে এক গাড়িবোমা হামলায় লেবাননের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরি নিহত হন। আগামীকাল শুক্রবার নেদারল্যান্ডসে জাতিসংঘের এক বিশেষ ট্রাইব্যুনালে ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে মামলার রায় হওয়ার কথা।

এদিকে ইসরায়েল-লেবানন সীমান্তে ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ কয়েক দিন ধরেই চলছিল। হিজবুল্লাহর দাবি, মঙ্গলবারের ভয়াবহ বিস্ফোরণ ইসরায়েলের চক্রান্ত। তবে হিজবুল্লাহর দাবির সপক্ষে এখনো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আর ইসরায়েল এই দাবি উড়িয়ে দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে।

আর ঘটনার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, বৈরুতে যে বিস্ফোরণ ঘটেছে তা কোনো কারখানার বিস্ফোরণ নয় বরং এটি কোনো না কোনোভাবে বোমা হামলা। গতকাল হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে ট্রাম্প লেবাননকে যেকোনো ধরনের সাহায্যের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তুতির কথা জানান। তিনি বলেন, ‘আমি আমেরিকার কয়েকজন জেনারেলের সঙ্গে আলাপ করেছি। তাঁরা আমাকে বলেছেন, এটি কোনো কারখানার বিস্ফোরণ নয় বরং এটি একটি বোমা হামলা।’

অন্যদিকে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি সহায়তার প্রতিশ্রুতির বার্তা পাঠিয়েছেন লেবাননের প্রেসিডেন্ট মিশেল আউনের কাছে। ইরানের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রধান কারিম হেম্মাতি বলেছেন, প্রথম পর্যায়ে দুই হাজার প্যাকেট খাবারের পাশাপাশি ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। খাবারের প্যাকেটগুলোর ওজন হচ্ছে ৯ টন। তিনি আরো জানিয়েছেন, ইরান বৈরুতে একটি ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করবে এবং ২২ সদস্যের একটি চিকিৎসকদল পাঠাবে। গতকাল বিকেলেই ওই চিকিৎসকদল বিমানযোগে বৈরুত পৌঁছানোর কথা। গতকাল চিকিৎসাসামগ্রী পাঠিয়েছে কাতার।

জর্দানের বাদশাহ দ্বিতীয় আব্দুল্লাহ লেবাননে অস্থায়ী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন। নেদারল্যান্ডস বলছে, তারা লেবাননের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করতে ৬৭ জনের একটি দল পাঠাবে, যেখানে চিকিৎসক, পুলিশ কর্মকর্তা ও ফায়ার সার্ভিস কর্মী থাকবেন। সৌদি আরব বলছে, তারা গভীরভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।

বৈরুতে বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি বলেছেন, এই ভয়ংকর বিস্ফোরণে শান্তিরক্ষা মিশনের বেশ কয়েকজন সদস্যও আহত হয়েছেন। সূত্র : এএফপি, বিবিসি, আলজাজিরা।

আরো পড়ুন