খায়রুল বাশার আশিক >>
আমরা ভ্রমণ কেন করি? এমন প্রশ্নের উত্তর হয়তো একেক জন একেক রকম দেবেন। কেউ ভ্রমণ করেন বিনোদনের অংশ হিসেবে। কেউ ভ্রমণ করেন মানসিক তৃপ্তির আশায়। আবার কেউ বা ভ্রমণ করেন প্রাণ-প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে। অনেকেই ভ্রমণ করেন নেশা ও পেশার দায়ে। ভ্রমণ করতে হয় একটি দেশের জনপদ সম্পর্কে জানতে-বুঝতে। কেউ কেউ ভ্রমণ করেন জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজনে। নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভ্রমণ হতে পারে। তবে লক্ষ্য যদি হয় ভ্রমণের মাধ্যমে মানুষের জীবন ও জীবিকা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন, তবে আপনি একবার হলেও ভ্রমণ করুন বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে।
আবহাওয়া ও জলবায়ু বিবেচনায় বাংলাদেশে উপকূলীয় জেলা মোট ১৯টি। ৭১০ কিলোমিটার সমুদ্র তটরেখার কোল ঘেঁষা উপকূলকে ভাগ করা হয়েছে তিন ভাগে। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর নিয়ে গঠিত পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চল। বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, শরীয়তপুর জেলা অবস্থান করছে মধ্য উপকূলে। এ ছাড়া খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ জেলাকে বিবেচনা করা হয় পশ্চিম উপকূল হিসেবে।
পশ্চিমে সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে শুরু করে পূর্বে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত হাজার কিছু দেখার আছে উপকূলে। বড়-ছোট নদী-খাল, জোয়ার-ভাটার চিরায়ত খেলা, মান্তা সম্প্রদায়, বেদে, আদিবাসী ও উপজাতির বসবাস, ম্যানগ্রোভ বন-বনানী, নদীর মাঝে জেগে থাকা দ্বীপ-চর, কৃষকের হালচাষ ও হলুদ পাকা ধানের ক্ষেত, মাঠভরা গরু-মহিষের পাল, মেঠো পথে কৃষ্ণচূড়া শিমুল-কদমের সমাহার, জেলেপল্লির চালচিত্র, শুঁটকিপল্লির শ্রমিকদের কর্মপন্থা, একাধিক ইকো পার্কসহ অনেক কিছু থেকে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ রয়েছে উপকূল ভ্রমণের মাধ্যমে।
উপকূলের একাধিক দর্শনীয় স্থান দেখার সঙ্গে সঙ্গে আপনি জানতে পারবেন সেখানকার মানুষের জীবন ও জীবিকা সম্পর্কে। পূর্ব উপকূল ভ্রমণ করে সরেজমিন দেখা যাবে লবণ চাষ, পাহাড়ি দ্বীপসহ অনেক কিছুই। মধ্য উপকূলে দেখা যাবে ইলিশ আহরণ, নৌ-যোগাযোগের নির্ভরতা। পশ্চিম উপকূল ভ্রমণে গেলে আপনাকে মুগ্ধ করবে সুন্দরবন। দেখতে পাবেন বনজীবীদের কাঠ, মধু ও গোলপাতা আহরণের দৃশ্য। উপকূলের মানুষের সঙ্গে নদীমাতৃক সম্পর্কের নানা দিক আপনাকে কৌতূহলী করে তুলবে।
উপকূলের নদীতে নৌকা কিংবা ট্রলার ভ্রমণে দেখা যাবে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য। নদীর মাঝে জেগে থাকা চরে পাখিদের ওড়াউড়ি, গাঙচিলের খুনসুটি, নদীর বুকে সূর্যাস্তসহ নান্দনিক অনেক কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে উপকূলের নদীপথে। উপকূলীয় যেকোনো খাবারের দোকানে পাওয়া যাবে নদী বা সমুদ্রের হরেক তাজা মাছ।
উপকূলীয় অঞ্চলের মেঠো পথে হাঁটলে আপনার মনে হবে উপকূল যেন এক সৈকতে সবুজ জনপদ। কিন্তু সেখানেও লুকিয়ে আছে প্রাকৃতিক বৈরিতা, সেগুলো আপনি অনুধাবন করতে পারবেন। দেখতে পাবেন নদীভাঙন কবলিত জনপদের কষ্টের চিত্র। আরো দেখতে পাবেন নদীতীরের বেড়িবাঁধে আশ্রয় নেওয়া মানবেতর জীবনযাপন। লবণাক্ততার প্রভাবে কৃষকদের হতাশার কথাও শুনতে পাবেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মাছচাষির কান্না আপনাকে ভাবিয়ে তুলবে। বাঁশ-কাঠ-খড়ের ঘরে কীভাবে উপকূলের মানুষ বাঁচে ঝড়-বন্যার মাঝে, সেটাও বুঝে নিতে পারবেন সরেজমিন ভ্রমণে। জোয়ারের পানি বৃদ্ধি, সুপেয় পানির দুষ্প্রাপ্যতা, যোগাযোগ ও যাতায়াত বিপন্নতা, জলাবদ্ধতাসহ নানাকিছু আপনাকে উপকূলীয় মানুষের কষ্টে ভরা জীবনের চিত্র বাস্তবে বুঝিয়ে দেবে।
উপকূলের মানুষের সঙ্গে গল্প-আড্ডায় আপনি শুনতে পাবেন তাঁদের জীবনে মিশে থাকা নানান কথা। সুপার সাইক্লোন সিডর, আইলা, আম্পানের মতো ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতের গল্প। জলদস্যুদের দস্যিপনা আর চর দখলের গল্পও জানতে পারবেন। জেলেদের মুখ থেকেই শুনতে পাবেন মৎস্য আহরণে নিষেধাজ্ঞার সময়ে জেলেদের কষ্টের কথা।
নানান সমস্যার পরও উপকূলে আছে ভ্রমণ বৈচিত্র্য। প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষের সুখ-দুঃখের দিনাতিপাত হয় উপকূলজুড়ে। এসব বিষয় নিজ চোখে দেখতে, বুঝতে, মন থেকে অনুধাবন করতে ভ্রমণ করুন উপকূলে।