সারাদেশে লকডাউনে মানুষ যখন ঘরবন্দি ছিল, ঠিক তখনই কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ফিরে এসেছিল ৩০ বছর আগের অবিশ্বাস্য দৃশ্য। বিশ্বময় করোনার তাণ্ডবে মানুষ যখন অসহায় হয়ে ঘরে বন্দি ছিল, প্রকৃতি তখন ফেলেছিল স্বস্তির নিঃশ্বাস। সমুদ্রের নীল জলে উচ্ছ্বসিত ছিল প্রাণিকুল। বাতাসে দ্রুত কমেছিল দূষণ। পাহাড়েও বইছিল নির্মল সমীরণ। আকাশে ছিল না কার্বন, ছিল মেঘমুক্ত খোলা আকাশ, গাছে গাছে ফুল ফুটছে- প্রকৃতি যেন বহুকাল পরে আপন আলোয় ফিরেছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এমন চিত্র আর বেশিদিন আমরা দেখতে পেলাম না। এর মধ্যেই কক্সবাজার জনশূন্য সমুদ্রসৈকতে হঠাৎ ভেসে এসেছে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য। এর মধ্যে প্লাস্টিক, ইলেক্ট্রনিক্স বর্জ্য ছাড়াও দেশি-বিদেশি মদের খালি বোতল, ছেঁড়া জালসহ নানা প্রকার বর্জ্য রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, সমুদ্রের জোয়ারের পানিতে এসব বর্জ্য ভেসে এসে কূলে ভিড়েছে। সৈকতের ভ্যালি হ্যাচারি থেকে দরিয়া নগর পয়েন্ট পর্যন্ত এসব বর্জ্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। হঠাৎ এত বর্জ্য কীভাবে এসেছে তার অনুসন্ধান শুরু করেছে প্রশাসন। করোনা সংকটে দীর্ঘ সাড়ে তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে কক্সবাজার সৈকতসহ এখানকার হোটেল ও সব পর্যটন কেন্দ্র। কিন্তু জনশূন্য এই সমুদ্রসৈকত সয়লাব হয়ে গেছে বিপুল পরিমাণ বর্জ্যে। বিশেষ করে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের কলাতলী, দরিয়ানগর থেকে শুরু করে হিমছড়ি সৈকত এলাকা পর্যন্ত একের পর এক বর্জ্য ভেসে এসেছে।
জনসাধারণের ধারণা, জনশূন্য সমুদ্রসৈকতে কিছু অসাধু হোটেল ব্যবসায়ী হোটেলের বর্জ্য সাগরে নিক্ষেপ করেছে। দীর্ঘ এলাকাজুড়ে বর্জ্যে সয়লাব হয়ে যাওয়ার ঘটনাটিও তাদের কাছে প্রথম। এসব বর্জ্যের স্তূপের সঙ্গে মৃত কাছিম ভেসে আসায় বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এর ফলে আশপাশের পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। এসব বর্জ্যে সামুদ্রিক মাছসহ বিভিন্নভাবে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটতে পারে। তাই দ্রুত বর্জ্যগুলো সাগর থেকে অপসারণ করা জরুরি।
কক্সবাজারের কলাতলীতে অবস্থিত হোটেলগুলো মলমূত্রসহ অন্যান্য আবর্জনা সরাসরি সৈকতের পানিতে ফেলে। তার ওপর নির্জন সৈকতে কেউ না থাকার সুযোগে বর্জ্যগুলো কেউ সাগরে ফেলে দিয়েছে। হয়তো অসাধু হোটেল কর্তৃপক্ষ মনে করেছিল সাগরের পানিতে এসব বর্জ্য ভেসে যাবে, কিন্তু সাগরের পানি বর্জ্যগুলোকে উল্টো তীরে ভিড়িয়ে দিয়েছে। আবার অনেকের ধারণা, সাগরে মাছ ধরার ট্রলার থেকে এসব বর্জ্য সাগরে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এতে করে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক কারণে বর্জ্যগুলো ভেসে আসতে পারে। বিষয়টি অনুসন্ধান করে সাগরে বর্জ্য নিক্ষেপকারীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। পর্যটকশূন্য কক্সবাজার সৈকতে বিরল প্রজাতির ডলফিনের দল সাগরের নীল জলে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলা করছিল। কলাতলী সমুদ্রসৈকতের একদম কাছেই ডলফিনগুলোকে খেলা করতে দেখা গেছে। সমুদ্রের পাড় থেকে ডলফিনের খেলা করার দৃশ্য পরিস্কার দেখা গিয়েছিল। ওই অপরূপ দৃশ্য অবলোকন করেছিলেন স্থানীয় লোকজন, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভাইরাল হয়েছে।
মানব জাতিকে সুস্থ থাকতে হলে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে এই পরিবেশের। বেঁচে থাকতে হলে প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করেই বাঁচতে হবে। লড়াই করার জন্য ইমিউনিটি অর্জন করতে হবে। আর এই শক্তির মূল উৎস প্রকৃতি। সবকিছুই আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণে পাই প্রকৃতিতে, যে প্রকৃতি তার দানের অপার ভান্ডার অবারিত করে দিয়েছে আমাদের, সেই প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে, যত্ন করতে হবে। কোনোভাবে ধ্বংস করা যাবে না। প্রকৃতি বিরূপ হলে আমরা বাঁচব না। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিনিয়ত কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সমুদ্রসৈকতেও বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এর ফলে প্রকৃতি মারাত্মক হুমকির মুখে পতিত হচ্ছে। আমাদের এখনই সতর্ক হতে হবে এবং পরিবেশ দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে পুরো পৃথিবীকে।
ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়