কুহকী বাস্তবের ওপারে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

 

 

১০১ বার দেখা হয়েছে

মুহম্মদ মুহসীন >>

৪ আগস্ট ২০২০ তারিখ সন্ধ্যায় অভিশপ্ত ভাইরাস করোনা বাংলা সাহিত্য-অঙ্গনে আরেকটি করুণ ঘটনা ঘটিয়ে গেল। করোনার আক্রমণে জীবনযুদ্ধে পরাস্ত হয়ে কুহকী বাস্তবের এই জগতের ওপারে চলে গেলেন উপমহাদেশের অদ্বিতীয় অনুবাদক ও বিশ্বসাহিত্যের উচ্চমার্গীয় একজন অধ্যাপক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি জানি গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক থেকে। এই জানা তাঁর অনুবাদের পাঠ থেকে। তাঁর অনুবাদের মাধ্যমেই সাহিত্যগত কুহকী বাস্তবতা তথা জাদুবাস্তবতার তাত্ত্বিক স্থপতি আলেহো কার্পেন্তিয়েরকে প্রথম জানতে পাই। তাঁর অনুবাদের মাধ্যমেই জানতে পারি মার্কেজের গুরু হুয়ান রুলফোকে। তখন পর্যন্ত কার্পেন্তিয়ের, রুলফো, কিংবা কার্লোস ফুয়েন্তেসের বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ বাংলাদেশে লভ্য হয়ে ওঠেনি। একমাত্র মার্কেসের দু–একটি ইংরেজি বই তখন আমাদের আজিজের শৌখিন দোকানগুলোর দু–একটায় পাওয়া যেত। ইংরেজি অনুবাদ লভ্য হয়ে ওঠার আগেই বাংলা অনুবাদ পেয়ে যাওয়ায় আমার মতো এপার ও ওপার বাংলার হাজারো পাঠকের সঙ্গে রুলফো, কার্পেন্তিয়ের, য়োসা, আস্তুরিয়াস, মাশাদো দো আসিস, সারামাগো প্রমুখ লাতিন আমেরিকার সাহিত্যিকের পরিচয়ই ঘটেছে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে। তিনিই আমাদের চিনিয়েছেন লাতিন আমেরিকার বুম-পিরিয়ড ও তৎপরবর্তী সময়ের দুনিয়া-কাঁপানো সাহিত্যকর্মগুলোকে।

মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদ বিশেষ করে আমার একাডেমিক জীবনের গতিপথই পাল্টে দিয়েছিল। তাঁর অনুবাদে রুলফো পড়ে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম রুলফোর ওপর আমার পিএইচডি গবেষণা পরিচালনার। এ নিয়ে প্রাথমিক সুলুক সন্ধানের আশায় আমি আমার বন্ধু শামীম রেজার মাধ্যমে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দু–একবার ফোনে আলোচনাও করেছিলাম। প্রতিবারের ফোনালাপেই আমি বুঝতে পারছিলাম আমি লাতিন আমেরিকার সাহিত্য বিষয়ে কতখানি বুদ্ধু। তারপরও বুদ্ধুদের মূর্খ সাহসই আমাকে টিকিয়ে রেখেছিল আমার গবেষণার বিষয়ের ওপর এবং শেষ পর্যন্ত সেই বুদ্ধু সাধনা সফলও হয়েছিল। তবে প্রথম হোঁচট খাওয়ার বিষয়টি উতরে গিয়েছিলাম এই মহিরুহের নামটি উচ্চারণের মধ্য দিয়েই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব হায়ার স্টাডিজের একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি রুলফোর ওপর কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত স্প্যানিশ জানি কি না। উত্তরে বলেছিলাম লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের ওপর এই দুই বাংলার অবিসংবাদিত বিশেষজ্ঞ মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই রুলফো অনুবাদ পর্যায়ের স্প্যানিশ জানেন না; সুতরাং আমি মনে করি, আমিও মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো টুকটাক স্প্যানিশ জেনেই রুলফোর ওপর কাজটা চালিয়ে যেতে পারব। আমার উত্তরটা নিঃসন্দেহে স্পর্ধামূলক ও মূর্খসুলভ হয়েছিল। তারপরও রেফারেন্সে উচ্চারিত নামটি মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বলেই হয়তো বোর্ড অব হায়ার স্টাডিজ আমার প্রস্তাবটি পার করে দিয়েছিল।

মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামের প্রতি এই সমীহ তাঁর অনুবাদের যোগ্যতার ওপরে শুধু প্রতিষ্ঠিত নয়, বরং একজন উচ্চমার্গীয় একাডেমিক হিসেবে তাঁর অবস্থানের ওপরও এই সমীহ প্রতিষ্ঠিত। একাডেমিক হিসেবে তাঁর ছিল বর্ণাঢ্য এক সফলতার জীবন। জন্ম আমাদের বাংলাদেশে সিলেট জেলায় হলেও তাঁর স্কুলজীবন কেটেছে আসাম ও ত্রিপুরায়। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কেটেছে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভারতীয় নন্দনতত্ত্বের ওপর উচ্চতর গবেষণা করেছেন কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিল্পের ইতিহাসের ওপর পড়াশোনা করেছেন পোল্যান্ডের ভাসভি বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রথম অধ্যাপনা শুরু করেন বার্মার ইয়াঙ্গুনে। তারপর পুরো অধ্যাপনার জীবনই কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। মূলত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগটি তাঁর হাত ধরেই গড়ে ওঠা। তাঁর মতো বিশ্বসাহিত্যের একজন পণ্ডিত ও সমঝদার থাকার সুবাদেই এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা গার্সিয়া মার্কেসকে তাদের সিলেবাসে পেয়েছে সত্তরের দশকে, যখন পর্যন্ত মার্কেস নোবেল প্রাইজ পাননি বলে জগতে তেমন পরিচিত কেউ নন। তিনি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন বলেই এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্লাসে লেকচার শুনেছেন চিলির কবি নিকানোর পাররার, যিনি তাদের বোঝাতেন অ্যান্টি পোয়েট্রি বা প্রতি কবিতা। তাঁর মতো পণ্ডিত বিভাগে ছিলেন বলেই সেই বিভাগে তৈরি হতে পেরেছে শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো পণ্ডিত ও শিক্ষক। শঙ্খ ঘোষের মতো বড় মাপের মানুষও অকপটে বলেছেন যে তাঁকে শিক্ষিত করে তুলেছেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। হামীম কামরুল হক তাঁর এক লেখায় কিন্নর রায়কে উদ্ধৃত করে বলেছেন, ‘বইপত্র কে কেমন পড়ে বলতে পারব না, তবে পাঠক হিসেবে মানবদার কোনো তুলনা নেই।’
পাণ্ডিত্য, পাঠ, অনুবাদ, সৃষ্টিশীল রচনা—এমন অনেকমুখো কীর্তির দিকে তাকিয়ে বিস্মিত গৌতম চক্রবর্তী ২১ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় একটু মজা করে লিখেছেন, ‘বাংলায় তিনজন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। একজন ক্রিকেটার সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাদা, ছোটদের জন্য ক্রিকেটের গল্প থেকে জুল ভের্ন অনুবাদ সবেতেই সিদ্ধহস্ত। দ্বিতীয় মানবেন্দ্র দক্ষ অনুবাদশিল্পী। তাঁর হাত ধরেই কৃষণ চন্দর, গিরিশ কারনাড থেকে বরিস পাস্তেরনাক, লোরকা, গার্সিয়া মার্কেস, পিটার বিকসেল অনেকে নাড়া দিয়েছেন বাংলা সংস্কৃতিকে। তৃতীয়জন তুলনামূলক সাহিত্যের জনপ্রিয় অধ্যাপক।’ বলার কথা হলো, এই তিনজনই একজন, একজনই মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। একজনের এত গুণ, তাই ভাগ করে তিন নামে বলা।

আসলেই তা–ই। ধন্ধেই পড়তে হয়। একজনের পক্ষে এত কাজ-সৃষ্টি, শিক্ষকতা, অনুবাদ—এত কিছু করা সম্ভব? অনুবাদে তো তিনি কোনো ব্যক্তিমাত্র নন, অনুবাদে তিনি একাই যেন একটি আস্ত ইনস্টিটিউশন। মালয়ালম সাহিত্যের ভৈকম মুহম্মদ বশীরকে আমরা বাংলায় পেলাম মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদে। উর্দু সাহিত্যিক কৃষণ চন্দরকে আমরা বাংলায় পেলাম তাঁর অনুবাদে। কানাড়া ভাষার গিরিশ কারনাডকে আমরা বাংলায় পেলাম তাঁর অনুবাদে। এ তো গেল ভারতের ভেতরের কথা। ইউরোপের কোন ভাষার লেখক আছে যাঁকে আমরা মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে বাংলায় পাইনি? রাশিয়ান সাহিত্যিক বরিস পাস্তেরনাক, স্প্যানিশ কবি লোরকা, ডেনিশ লেখক অ্যান্ডারসন, বেলজিয়ান লেখক জর্জ রেমি, চেক ভাষার কবি মিরোস্লাভ হোলুব, পোলিশ ভাষার কবি চেসোয়াভ মিউশ, পোলিশ লেখক স্তানিসোয়াভ লেম, সার্বিয়ান কবি ভাসকো পোপা, অস্ট্রিয়ান কবি পিটার হ্যান্ডকে, জার্মান কবি এনৎসেনসবার্গার—এঁদের প্রত্যেককে আমরা বাংলায় পেয়েছি তাঁর অনুবাদে। তাঁর অনূদিত বেলজিয়ান লেখক জর্জ রেমির কমিক সিরিজ ‘টিনটিন’-এ তো একসময় দুই বাংলার কিশোরেরা ডুবে ছিল।

বই দেখছেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীতএ তো গেল ইউরোপ। লাতিন আমেরিকার তো বলতে গেলে পুরোটাই বাংলায় এক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদ। মার্কেসের ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ দিয়ে কর্নেলের যে দুঃখের আঙিনায় মানবেন্দ্র আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন সেই আঙিনায় রেখেই তিনি আমাদের স্বাদ পাইয়েছেন সারা দুনিয়াকে মোহিত করে দেওয়া লাতিন আমেরিকান জাদুবাস্তবতার। লাতিন আমেরিকার কবিতার ঐন্দ্রজালিকতা আর উপন্যাসের জাদুবাস্তবতাকে আমাদের কাছে উপস্থাপন করতে লাতিন আমেরিকার মহিরুহ সাহিত্যিক কাউকেই তিনি বাদ দিতে চাননি তাঁর অনুবাদ থেকে। মেক্সিকোর কথাসাহিত্যিক রুলফো, মেক্সিকোর কবি হোসে এমিলিও, কিউবার কার্পেন্তিয়ের, কলম্বিয়ার মার্কেস, পেরুর ভার্গাস য়োসা, গুয়াতেমালার আস্তুরিয়াস, ব্রাজিলের মাশাদো দো আসিস, আর্জেন্টিনার কোর্তাসার, চিলির গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, চিলির নিকানোর পাররা, মার্তিনিকের এমে সেজেয়ার—এতগুলো নাম তো একশ্বাসেই বলা গেল যাঁদের কালজয়ী বিভিন্ন সৃষ্টিকর্ম মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলায় তুলে এনেছেন তাঁর বাঙালি পাঠকদের জন্য। ইউরোপ-আমেরিকার বাইরে এমনকি আফ্রিকার সুদানীয় আরবি সাহিত্যিক তায়িব সালেহর ‘মাওসিম আল-হিজরাহ ইলা আল-শিমাল’ উপন্যাসের অনুবাদও আমরা বাংলায় পাই মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে। কোনো একক ব্যক্তি দূরে থাক, এমন কোনো অনুবাদ প্রতিষ্ঠানও এই বাংলায় পাওয়া যাবে না যেখান থেকে বহু দেশীয় এত সংখ্যক মহিরুহ সাহিত্যিকের কালজয়ী গ্রন্থ বাংলায় অনূদিত হয়েছে। প্রগতি বা রাদুগাও এত বহু দেশীয় কালজয়ী সব গ্রন্থের অনুবাদ সম্পাদন করতে পারেনি, যেহেতু অনুবাদে এই প্রতিষ্ঠানদ্বয়ের প্রতিশ্রুতি যতটা ছিল মতাদর্শিক প্রচারণার প্রতি, ততটা ছিল না সাহিত্যের প্রতি। অবশ্য এ দুটি প্রতিষ্ঠানের অবদানকে বাংলা সাহিত্যে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। ফলে বাংলা অনুবাদ সাহিত্যে মানবেন্দ্র নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান ছিলেন বললেও কমই বলা হয়। সত্যি বলতে তাঁর অনুবাদের এই দিগন্তবিস্তৃত সম্ভার বাংলার পাঠককে ইংরেজি সাহিত্যের ঔপনিবেশিক কবজা থেকে মুক্ত করে এনেছিল। তাঁর অনুবাদের বিশাল সম্ভারের মধ্য দিয়েই বাঙালি পাঠকেরা বিশ্বসাহিত্য বলতে বুঝতে শিখল লাতিন আমেরিকার বিশাল সাহিত্যসম্ভারকে এবং পূর্ব ইউরোপসহ আফ্রিকার সাহিত্যসম্ভারকে। এর আগে বাঙালি পাঠক বিশ্বসাহিত্য বলতে যেন শেক্‌সপিয়ার, মিল্টন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ আর এলিয়টের মধ্যে আটকে গিয়েছিল।

সাহিত্যের যে শাখায় মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের এমন গগনচুম্বী অবদানের কথা এতক্ষণ বলা হলো, তাকে অনুবাদ নামে বর্ণনা করতে কিন্তু মানবেন্দ্র নিজে রাজি ছিলেন না। তিনি কৌতুকচ্ছলে বলতেন অনুবাদ হলো অণু-পরমাণু সব বাদ দেওয়া। তিনি অমন বাদ দেওয়ার কাজকে মূল্যহীন মনে করতেন। তাই তিনি এ শাখার নাম বলতেন তরজমা। তাঁর মতে তরজমা হলো সেই কাজ যেখানে মূল টেক্সটটি জমা পড়ে, বাদ যায় না। আর তাঁর তরজমায় তিনি শুধু টেক্সটটি তরজমা করেই তাঁর কাজ শেষ করেননি। ওই টেক্সট বোঝার জন্য যে তাত্ত্বিক ভিত্তিটি লাগবে প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ লিখে সেই তাত্ত্বিক ভিত্তিটি পাঠকের মধ্যে তৈরি করার দায়টিও তিনি সম্পন্ন করেছেন। বুম পিরিয়ড ও তৎপরবর্তী লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের তাত্ত্বিক ভিত্তি হলো জাদুবাস্তবতা। বাঙালিকে এই জাদুবাস্তবতার ধারণাও মানবেন্দ্রই শিখিয়েছেন। তাঁর ‘বাস্তবের কুহক কুহকের বাস্তব’ গ্রন্থের ১৬টি প্রবন্ধের সব কটিই কোনো না কোনো দিক থেকে আমেরিকার জাদুবস্তবতাকে বুঝতে সাহায্য করে।

সাহিত্যের যে শাখায় মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের এমন গগনচুম্বী অবদানের কথা এতক্ষণ বলা হলো, তাকে অনুবাদ নামে বর্ণনা করতে কিন্তু মানবেন্দ্র নিজে রাজি ছিলেন না। তিনি কৌতুকচ্ছলে বলতেন অনুবাদ হলো অণু-পরমাণু সব বাদ দেওয়া। তিনি অমন বাদ দেওয়ার কাজকে মূল্যহীন মনে করতেন। তাই তিনি এ শাখার নাম বলতেন তরজমা। তাঁর মতে তরজমা হলো সেই কাজ যেখানে মূল টেক্সটটি জমা পড়ে, বাদ যায় না।


এ বিষয়ে একটা কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার যে ইউরোপের ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’ ধারণা দিয়ে যে লাতিন আমেরিকার উপন্যাসকে বোঝা যাবে না এ কথা মানবেন্দ্র সেই শুরুতেই বুঝেছিলেন। ইউরোপীয় ম্যাজিক রিয়ালজিম দিয়ে আলফ্রেড কুবিন বা ডব্লিউ ই সুসকিন্ডকে বোঝা যেতে পারে, বোঝা যেতে পারে মিলান কুন্ডেরা বা অ্যাঞ্জেলা কার্টারকে। কিন্তু ইউরোপীয় ম্যাজিক রিয়ালিজম বা তদর্থের জাদুবাস্তবতা দিয়ে আস্তুরিয়াস বা কার্পেন্তিয়ের বা মার্কেসকে বোঝা যাবে না। এঁদের বুঝতে হলে যে জাদুবাস্তবতার শরণাপন্ন হতে হবে তার মূল নাম ‘লো রেয়াল মারাভিয়োসো’। এই অর্থের জাদুবাস্তবতাকে বোঝানোর জন্য মানবেন্দ্র এই প্রবন্ধগুলোয় ‘জাদুবাস্তবতা’ শব্দটিই সযত্নে পরিহার করেছেন, কারণ সেটির সঙ্গে পাঠক ইউরোপীয় ম্যাজিক রিয়ালিজমকে গুলিয়ে ফেলতে পারে। তার পরিবর্তে তিনি ব্যবহার করেছেন ‘কুহকের বাস্তব’ শব্দটি। তাঁর এ শব্দটি বাঙালি পাঠক একটি তাত্ত্বিক প্রত্যয় হিসেবে গ্রহণ না করলেও এর মধ্য দিয়ে পাঠক জাদুবাস্তবতার সেই ভাবকাঠামোটি বুঝতে পেরেছে, যেটি বুঝলে লাতিন আমেরিকার কথাসাহিত্যের বাস্তবতার স্বরূপটি পাঠকের কাছে যথাযথভাবে ধরা দেবে। দিয়েছেও তা–ই। তাই বলেই বাঙালি পাঠক আজ জাদুবাস্তব ঔপন্যাসিক হিসেবে মিলান কুন্ডেরা বা গুন্টার গ্রাসের চেয়ে অনেক বেশি পড়ছে মার্কেস, রুলফো বা কার্পেন্তিয়েরকে।

এত করে যে তরজমাকারের কথা বলা হলো তাঁর কৃতিত্ব যে শুধু তরজমায় নয় সে কথা আগেই বলা হয়েছে। সৃষ্টিশীল সাহিত্যে তাঁর অবদানও কোনোভাবে অনুল্লেখ্য নয়। তিনি একাধারে একজন কবি ও কথাসাহিত্যিক ছিলেন। তিনি কলকাতার ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীর কবি ছিলেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘অর্ধেক শিকারী’, ‘উপদ্রুত উপত্যকা’, ‘বাঁচাকাহিনী’, ‘সাপলুডো অথবা ঘরবাড়ি’, ‘এই সময় শনির’—সবই তৎকালীন সময়ে প্রশংসা কুড়িয়েছিল। গৌতম চক্রবর্তীর বর্ণনাসূত্রে বলা দরকার যে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের খেলাবিষয়ক গ্রন্থগুলোও অবিস্মরণীয়। ‘খেলা অমনিবাস’ (১ম ও ২য় খণ্ড), ‘খেলা সমাচার’, ‘ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটে জয়ের প্রস্তুতিপর্ব’—এসব বই বলা যায় মতি নন্দীর বইগুলোর পরে খেলাধুলাবিষয়ক সাহিত্যে টিকে থাকার মতো কতিপয় আস্ত আস্ত বই। শিশুসাহিত্যে তাঁর অনুবাদ যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে ‘হরবোলা’ ও ‘জিয়নকাঠি’র মতো মৌলিক বই। এ ছাড়া মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদনায় পেয়েছি আমরা কতিপয় অসামান্য সংকলন গ্রন্থ। পাঁচ খণ্ডে সংকলিত তাঁর সম্পাদিত ভারতীয় গল্পগ্রন্থটি দেখিয়ে দেয় ভারতীয় বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যে তাঁর দিগন্তবিস্তৃত পাঠ। একই সঙ্গে রয়েছে বিশ্বসাহিত্য থেকে ছেঁকে নেওয়া শিশু–কিশোরদের গল্প, ছড়া ও লোককাহিনির সংকলন।

মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর এই বিশাল কর্ম ও কীর্তির কিছু স্বীকৃতি অবশ্য জীবদ্দশায় লাভ করেছেন। শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি খগেন্দ্রনাথ মিত্র স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছ থেকে তিনি লাভ করেছেন বিদ্যাসাগর পুরস্কার। অনুবাদে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য ভারতীয় সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারও তিনি লাভ করেছেন।

মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্ম ও কীর্তির বয়ান এর মধ্য দিয়েই শেষ হওয়ার নয়। তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি সম্মান জানাতে এ সামান্য শ্রদ্ধাঞ্জলিমাত্র। ১৯৩৮ সালের ১৫ এপ্রিল বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া এই ক্ষণজন্মা পুরুষ ৮২ বছর বয়সে ২০২০ সালের ৪ আগস্ট সন্ধ্যায় করোনার সঙ্গে যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। কিন্তু তিনি চলে যাননি বাংলা সাহিত্যকে ছেড়ে। যত দিন বাংলা সাহিত্য বেঁচে থাকবে তত দিন এই বাংলায় অমরত্বের আসনে আসীন থাকবেন আমাদের মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

আরো পড়ুন