যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘদিন যাবত বসবাসকারী ১ কোটি ১০ লাখ আনডকুমেন্টেড ইমিগ্রান্টদের আগামী আট বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কংগ্রেসকে আইন প্রণয়ন করতে বলবেন। তিনি তার দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে অবৈধভাবে বসবাসকারী ইমিগ্রান্টদের বৈধতা দানের রূপরেখাসহ এ সংক্রান্ত তার ঘোষণা দেবেন। এর ফলে সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর ইমিগ্রেশন নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে বলে আশা করছেন ডেমোক্রেটরা এবং ইমিগ্রান্ট কমিউনিটি, বিশেষ করে যারা ট্রাম্প প্রশাসনের সময় আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন যে যেকোন সময় তাদেরকে গণহারে আটক করে নিজ নিজ দেশে ডিপোর্ট করা হবে, তাদের মধ্যে স্বস্থি নেমে এসেছে। তবে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রস্তাবিত ইমিগ্রেশন বিল সম্পর্কে প্রকাশিত রিপোর্টগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে যে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারী পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে কোন বৈধতা ছাড়া বসবাসকারী ইমিগ্রান্টদের জন্য পাঁচ বছরের মধ্যে বৈধ অবস্থান বা গ্রীনকার্ড প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে এবং তারা যদি ইমিগ্রেশনের সকল শর্ত যেমন, তাদের যদি কোন ক্রিমিনাল রেকর্ড না থাকে, তারা যদি নিয়মিত ট্যাক্স পরিশোধ করাসহ অন্যান্য প্রয়োজন পূরণ করতে সক্ষম হয় তাহলে গ্রীনকার্ড পাওয়ার তিন বছর তারা সিটিজেনশিপ নিতে চাইলে ন্যাচারাইজেশন এর পথে অগ্রসর হতে পারবেন।
উল্লেখ্য, পিউ রিসার্চ সেন্টারের সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এক কোটি ৫০ লাখ অবৈধ ইমিগ্রান্ট ছিল, যা ২০০৭ সালে ১ কোটি ২২ লাখে উন্নীত হয়েছে। হোমল্যান্ড সিকিউরিটির হিসাব অনুযায়ী ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ১ কোটি ২০ লাখ অবৈধ ইমিগ্রান্ট বসবাস করছিল, যাদের ৮০ শতাংশই বসবাস করছে ১০ বছরের বেশি সময় যাবত এবং অবৈধ ইমিগ্রান্টদের অর্ধেকের বেশি মেক্সিকান। কিন্তু বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অবৈধ ইমিগ্রান্টের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে সরকারি বা বেসরকারি কোন সংস্থার কাছে নেই। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে অবৈধ ইমিগ্রান্টদের বৈধতা দানের বিষয় অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল এবং এই মুখ্য ইস্যুতে ল্যাটিনোসহ ইমিগ্রান্ট কমিউনিটি তাকে ব্যাপকভাবে সমর্থন জানিয়েছিল। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও অবৈধ ইমিগ্রান্টদের বৈধতা দানের জন্য কংগ্রেসের প্রতি প্রয়োজনীয় আইন পাস ও বিদ্যমান ইমিগ্রেশন আইন সংশোধনের জন্য কংগ্রেসের প্রতি বার বার আহবান জানিয়েছেন, কিন্তু রিপাবলিকানরা তা বার বার আটকে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৭ সালের জানুয়ারী মাসে দায়িত্ব গ্রহণের পর তাঁর প্রথম নির্বাহী আদেশে সাতটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করে এবং তখন থেকে একের পর এক ইমিগ্রেশন বিরোধী উদ্যোগ গ্রহণ করে আনডকুমেন্টেড ইমিগ্রান্টদের বৈধতা লাভের আশা গুড়িয়ে দেন। এমনকি বহুল আলোচিত ‘ডাকা’ (ডেফারড অ্যাকশন ফর চাইল্ডহুড অ্যারাইভ্যাল) এর আওতায় প্রেসিডেন্ট ওবামা যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে প্রবেশকারী অভিভাবকদের সন্তান, যারা শৈশবে এসেছে এবং এদেশেই বেড়ে উঠেছে এবং পড়াশোনা করেছে তাদেরকে যে সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্ট সেসব সুবিধাও রহিত করেন, যে কারণে তারাও চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে।
কিন্তু বাইডেনের এ উদ্যোগ ইতিপূর্বে যেভাবে রিপাবলিকানরা বাধাগ্রস্থ করেছে, একইভাবে বাধার সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন ইমিগ্রেশন অধিকার প্রবক্তারা। কিন্তু এ উদ্যোগ যদি সফল হয় তাহলে এটি হবে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের সময়ে প্রায় ৩০ লাখ অবৈধ ইমিগ্রান্টকে প্রদত্ত অ্যামনেস্টির পর ইমিগ্রান্টদের বৈধতা দানের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ। ন্যাশনাল ইমিগ্রেশন ল’ সেন্টারের এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর ম্যারিয়েলেনা হিনক্যাপি বলেছেন, ‘জো বাইডেনের ঘোষণা ট্রাম্পের ইমিগ্রান্ট বিরোধী পদক্ষেপের স্থলে ঐতিহাসিক এক পরিবর্তন, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত আনডকুমেন্টেড ইমিগ্রান্টদের কাঙ্খিত বৈধতা লাভের ইতিবাচক ইঙ্গিত রয়েছে।’
বাইডেনের চিফ অফ স্টাফ রন ক্লেইন গত শনিবার বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনেই কংগ্রেসে ইমিগ্রেশন বিল পাঠাবেন।’ কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু ব্যাখ্যা দেননি এবংব বাইডেনের অফিস থেকেও এ সংক্রান্ত কোনকিছু সুনির্দিষ্টভাবে বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তবে হোয়াইট হাউজের ডমেস্টিক পলিসি কাউন্সিলের ইমিগ্রেশন বিষয়ক ডেপুটি ডাইরেক্টর এস্থার অলিভারিয়া সম্ভাব্য ইমিগ্রেশন বিলের ওপর ইমিগ্রেশন অধিকার প্রবক্তাদের কিছুটা আলোকপাত করেছেন। লীগ অফ ল্যাটিন আমেরিকান সিটিজেনস এর সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোমিঙ্গো গর্সিয়া বলেছেন যে গত বৃহস্পতিবার বাইডেন ইমিগ্রেশন অধিকার প্রবক্তাদের সাথে কথা বলার সময় বলেছেন যে, সিনেটে ট্রাম্পের ইমপিচমেন্ট শুনানির সময় পর্যন্ত ইমিগ্রেশন বিল নিয়ে বিবেচনা বিলম্বিত হলেও তা তার দায়িত্বভার গ্রহণের ১০০ দিনের মধ্যে বিল পাস হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। গর্সিয়া বলেছেন, ‘বাইডেনের ঘোষণা আমাদেরকে বিস্মিত করেছে। আমরা কোন তড়িঘড়ি করছি না। কারণ বারাক ওবামা ২০০৯ সালে একই ধরনের প্রতিশ্রুতি দিলেও তার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছিল।’
ন্যাশনাল ইমিগ্রেশন ফোরামের প্রেসিডেন্ট আলী নূরানী, যিনি গত বৃহস্পতিবার রাতে বাইডেনের ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন, তিনি বলেছেন, আনডকুমেন্টেড ইমিগ্রান্টদের সিটিজেনশিপ দেয়ার জন্য যে সুযোগ সৃষ্টি করা হবে তাতে আনডকুমেন্টেড ইমিগ্রান্টদের বৈধতা লাভে আট বছর সময় লাগতে পারে। বাইডেনের ইমিগ্রেশন পরিকল্পনার সুবিধা সর্বাগ্রে লাভ করবে যারা ‘ডাকা’র আওতায় রয়েছে তারা এবং যারা টেম্পরারি প্রটেক্টেড স্ট্যাটাসের (টিপিএস) আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিসও একই কথা বলেছেন। এক সপ্তাহ আগে গত মঙ্গলবার ইউনিভিশনের সাথে এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘ডাকা’ ও ‘টিপিএস’ এর আওতায় থাকা ইমিগ্রান্টরা সহসাই গ্রীনকার্ড লাভ করবেন এবং অন্যান্য আনডকুমেন্টেড ইমিগ্রান্টদের বৈধতা পাওয়ার ক্ষেত্রে যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হবে, তাতে তারা আট বছর সময়সীমার মধ্যে সিটিজেনশিপ লাভ করবেন।
আশার কথা যে ডেমোক্রেটদের মধ্যে অবৈধ ইমিগ্রান্টদের বৈধতা দানের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করার হার আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এক সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১৬ সালে যেখানে ডেমোক্রেটদের ২১ শতাংশ ছিল, জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তা ৩৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তাছাড়া দেখা যায় যে ২০১৬ সালে ৭২ শতাংশ ডেমোক্রেট মনে করতেন যে ইমিগ্রেশনের অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে, এখন তা ৭৭ শতাংশ ডেমোক্রেট বিশ্বাস করেন। আলী নূরানীর মতে ২০১৮ সালে সীমান্তে ৫ হাজারের অধিক সংখ্যক শিশুকে তাদের পিতামাতার নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন করে আটকে রাখা এবং অনেককে অভিভাবকহীন অবস্থায় তাদের দেশে পাঠিয়ে দেয়ার ঘটনায় ভোটাররা ট্রাম্পের নীতি থেকে নিজেদেরকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে। যাদের মধ্যে অনেক রক্ষণশীল ও এভানজেলিক রয়েছেন, যারা ট্রাম্পের এহেন অমানবিক নীতির কট্টর বিরোধী। ‘ডাকা’ নিয়ে ট্রাম্পের বাড়াবাড়িও ট্রাম্পকে বিপুল সংখ্যক ইমিগ্রান্টকে ট্রাম্পকে সমর্থন করা থেকে দূরে রেখেছে। কারণ এর ফলে অনেকের মনে সন্দেহ দানা বেধে উঠেছিল যে তিনি এসব ইস্যুকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
অভিবাসীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাইডেনের : ডোনাল্ড ট্রাম্পের সব বিশৃঙ্খলা মুছে প্রেসিডেন্সির প্রথম দিন থেকেই কোমর বেঁধে মাঠে নামছেন জো বাইডেন। এর অংশ হিসেবে এদিনই নতুন অভিবাসন আইনের প্রস্তাব উত্থাপনের পরিকল্পনা করেছেন।
তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য আরোপিত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার কথা জানিয়েছে আসন্ন মার্কিন প্রশাসন। বুধবার দুপুরে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন বাইডেন। শপথগ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেই তিনি প্রশাসনিক কাজে হাত দিয়েছেন। এদিন নতুন অভিবাসন আইন প্রস্তাব করার পরিকল্পনা আছে তাঁর। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত এক কোটি ১০ লাখ অনিবন্ধিত অভিবাসীর বৈধ হওয়ার পথ খুলে যাবে আট বছরের মধ্যে। নতুন মার্কিন প্রশাসনের অভিবাসননীতির কেন্দ্রে থাকবে আট বছর মেয়াদি এক পরিকল্পনা। এর আওতায় অনিবন্ধিত অভিবাসীদের যোগ্যতার ভিত্তিতে পাঁচ বছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের অস্থায়ী অনুমতি দেওয়া হবে। এই পাঁচ বছরের মধ্যে তাদের সব তথ্য পরীক্ষা করে দেখা হবে। পাশাপাশি তারা নিয়মিত কর দেওয়াসহ অন্যান্য শর্ত পূর্ণ করলে পাঁচ বছর পর তাদের গ্রিন কার্ড দেওয়া হবে। এর তিন বছর পর তারা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবে। বাইডেনের পরিকল্পিত এই আইন বাস্তবায়নের জন্য মার্কিন কংগ্রেসের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। শুধু অভিবাসননীতি নয়, ট্রাম্পের আমলের সব গোলমেলে নীতি ফেলে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি বাইডেন দিয়েছেন আরো এক বছর আগে। এ ছাড়া করোনাকালে ট্রাম্প যেসব বিশৃঙ্খলার জন্ম দিয়েছেন, সেগুলোও নির্মূল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
করোনা সংক্রমণ রোধে ট্রাম্প যে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন, সেটা অবশ্য আপাতত উঠছে না; যদিও ওই নিষেধাজ্ঞা তোলার নির্দেশনা ট্রাম্প এরই মধ্যে দিয়েছেন। গত সোমবার হোয়াইট হাউসের জারি করা একটি ডিক্রিতে বলা হয়, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশির ভাগ দেশ ও ব্রাজিলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আগামী মঙ্গলবার থেকে তুলে নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন ট্রাম্প। এই আদেশ জারির কিছুক্ষণের মধ্যে বাইডেনের মুখপাত্র জেন সাকি টুইটারে বলেছেন, ‘আমাদের চিকিৎসকদলের পরামর্শ অনুযায়ী, ১/২৬-এ ওই বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার করতে চায় না প্রশাসন।’