করোনাভাইরাসকে সত্যিকারার্থে নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে আমাদেরকে জনগণকে সংগঠিত করে কমিউনিটি পর্যায় থেকে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এ লক্ষ্যে করোনাভাইরাস-সহনীয় গ্রাম সৃষ্টির উদ্যোগটি হতে পারে একটি অনুকরণীয় মডেল, যার সঙ্গে সরকারি প্রচেষ্টা যুক্ত হলে সারাদেশে তা বিস্তৃত করা সম্ভব হবে। আমরা এ উদ্যোগটির প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি
‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন’-এর মাধ্যমে করোনাভাইরাস এখন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে চীনের উহান শহর; যেখান থেকে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি, দেশে ফিরে আসা ২১৩ ছাত্রছাত্রী এবং মার্চ-এপ্রিল মাসে বিদেশ, বিশেষত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আগত ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা যায়নি। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের মতো কিছু হটস্পটে ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। এপ্রিলের শেষদিকে সাধারণ ছুটি; পরে দুই ঈদের সময়ে গ্রামমুখী মানুষের ঢলও এটিকে স্থানীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করেছে। তাই এখন দেশের সব নাগরিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।
এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের কোনো স্বীকৃত চিকিৎসা নেই। একটি কার্যকর ভ্যাকসিন কবে নাগাদ পাওয়া যেতে পারে, সেটিও এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নয়। তাই আমাদেরকে অনেক দিন এই ভাইরাসের সঙ্গে বসবাস করতে হবে বলে অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা। কিছু বিশেষজ্ঞ যেমন এন্থনি ফাউসির মতে, করোনাভাইরাস কোনোদিন নিমূর্?ল হবে না। বিশেষজ্ঞদের এসব মতামতের ভিত্তিতে দি হাঙ্গার প্রজেক্ট মার্চের শেষদিক থেকে দেশজুড়ে ‘করোনাভাইরাস-সহনশীল গ্রাম’ গড়ে তোলার উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। এটি বিকেন্দ্রীভূত এবং স্বেচ্ছাব্রতীদের নেতৃত্বে কমিউনিটি চালিত একটি উদ্যোগ।
করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সরাসরি দায়িত্ব না থাকলেও, আমরা ইউনিয়ন পরিষদগুলোর সঙ্গে ‘করোনাভাইরাস-সহনশীল গ্রাম’ তৈরিতে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছি। বর্তমান উদ্যোগটি আমাদের বিদ্যমান ‘এসডিজি ইউনিয়ন কৌশল’; যে কৌশল এসডিজি ‘স্থানীয়করণ’-এর লক্ষ্যে দি হাঙ্গার প্রজেক্ট ২০১৫ সালে উদ্ভাবন করে; ধারাবাহিকতাই সৃষ্ট। এসডিজি ইউনিয়ন কৌশলটি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় জড়িত গ্রাম উন্নয়ন দল (ভিডিটি) ও সেল্কম্ফ-হেল্প বা আত্ম-সহায়তাকারী গ্রুপের সদস্য এবং বিপুল সংখ্যক স্বেচ্ছাব্রতী হলেন ‘করোনাভাইরাস-সহনশীল গ্রাম’ সৃষ্টির মূল চালিকাশক্তি। উল্লেখ্য, এই স্বেচ্ছাব্রতীদের একটি বড় অংশ তরুণ।
মোটাদাগে করোনাভাইরাস-সহনশীল গ্রাম সৃষ্টির চারটি ধাপ রয়েছে। প্রথমত, ‘উই আর ইন ইট টুগেদার’; আমরা সবাই এর ঝুঁকিতে আছি- এমন এক বোধ জাগ্রত করা, যাতে করোনাভাইরাস থেকে সবার সুরক্ষার স্বার্থে সম্মিলিত উদ্যোগের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ‘প্রত্যেকের নিরাপত্তার ওপর সবার নিরাপত্তা নির্ভর করে’- এই বোধ নিজেদের কল্যাণ ও সুরক্ষার দায়িত্ব কমিউনিটিকে নিতে সহায়তা করে। একই সঙ্গে স্থানীয়ভাবে ভাইরাসটির সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রশমন প্রচেষ্টার সঙ্গে স্থানীয় জনগণের মালিকানা ও সম্পৃক্ততা সৃষ্টির পথ সুগম হয়। এ উপলব্ধি থেকে নিজেদের সুরক্ষার স্বার্থে তৃণমূলের মানুষ একত্রিত হয়ে ‘সামাজিক পুঁজি’ গড়ে তুলেছেন এবং কমিউনিটিতে করোনাভাইরাস প্রতিহত করার লক্ষ্যে একটি গণজাগরণ সৃষ্টির উদ্যোগ নিচ্ছেন। নিজেদের স্বার্থপ্রণোদিত এ গণ-উদ্যোগ সৃষ্টিতে দি হাঙ্গার প্রজেক্টের প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাব্রতীরা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছেন এবং তাদের নিজ পাড়া-প্রতিবেশীদের সংগঠিত করে ‘করোনাভাইরাস-সহনীয় গ্রাম’ সৃষ্টির ঘোষণা দিচ্ছেন ও পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হচ্ছেন।
দ্বিতীয়ত, সচেতনতা তৈরি; বিশেষত হাত ধোয়া, মাস্ক পরা এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে উৎসাহিত করার মাধ্যমে মানুষের ‘বিহেভিয়ার’ বা অভ্যাসে পরিবর্তন আনা, যাতে সংক্রমণের ‘চেইন’ ভেঙে পড়ে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার লক্ষ্যে আমাদের প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাব্রতীরা এ ধরনের একটি থ্রি-ডব্লিউ ক্যাম্পেইন- ওয়াশিং হ্যান্ডস, ওয়াচিং ডিস্ট্যান্স এবং ওয়্যারিং মাস্কস পরিচালনা করছেন। শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে লিফলেট বিতরণ এবং সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে তারা জনগণকে উদ্বুদ্ধ করছেন। স্বেচ্ছাব্রতীরা তাদের কাজে ইউনিয়ন হেল্থ ক্লিনিকে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীদের সহায়তা নিচ্ছেন। তারা সমাজের ধর্মীয় ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে করোনাভাইরাস সম্পর্কে বিভিন্ন অপতথ্য ও গুজব মোকাবিলা করতে যুক্ত করছেন। অনেক ইমাম এ লক্ষ্যে মসজিদে মুসল্লিদের সামনে খুতবা দিচ্ছেন। এ ছাড়াও করোনাভাইরাসের মহামারিকালে বেড়ে যাওয়া নারী-শিশু নির্যাতন ও বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে তারা জনগণকে সজাগ করছেন। উল্লেখ্য, মানুষের দীর্ঘদিনের মজ্জাগত অভ্যাস বদলানো দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ। তবে করোনাভাইরাস মহামারি থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে এ দুরূহ কাজটির কোনো বিকল্প নেই।
তৃতীয়ত, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিহ্নিত ও পৃথক করতে এবং স্বাস্থ্যসেবা পেতে সহায়তা করা। দি হাঙ্গার প্রজেক্টের স্বেচ্ছাব্রতীরা ভাইরাসের লক্ষণ দৃশ্যমান এমন ব্যক্তিদের পৃথক থাকতে এবং স্বাস্থ্যসেবা ও নমুনা পরীক্ষা পেতে সহায়তা করছেন। এ ব্যাপারে তারা স্থানীয় চিকিৎসকদের সহায়তা নিচ্ছেন। পাশাপাশি স্বেচ্ছাব্রতীরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কেউ যাতে নিগ্রহের শিকার না হন সে ব্যাপারে নজর রাখছেন। তারা বাইরে থেকে এলাকায় আগত ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থাও করছেন। সহায়তা করছেন সঠিকভাবে ভাইরাস সংক্রান্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে।
চতুর্থত, বিপন্ন মানুষদের তালিকাভুক্ত ও সহায়তা করা। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে জীবিকাহারা ও খাদ্যসংকটে নিপতিত ব্যক্তি ও পরিবারের তালিকা প্রণয়ন করছেন দি হাঙ্গার প্রজেক্টের প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাব্রতীরা। তালিকায় অগ্রাধিকার পায় নারীপ্রধান এবং শিশু ও প্রতিবন্ধী সদস্য রয়েছে এমন পরিবার। এসব পরিবারের মধ্যে যোগ্য যারা তারা যাতে সরকারি সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় আসতে পারে; স্বেচ্ছাব্রতীরা সে ব্যাপারে তাদের সহায়তা করছেন। একই সঙ্গে তারা স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে ‘কমিউনিটি ফিলান্থপি’র মাধ্যমে অর্থ, খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করে সাময়িক সহায়তার জন্য বিপন্ন মানুষের মধ্যে বিতরণ করছেন।
স্বেচ্ছাব্রতীদের নেতৃত্বে এবং পুরো সমাজের সম্পৃক্ততায় পরিচালিত এ কার্যক্রম ইতোমধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বর্তমানে প্রায় দেড় হাজার গ্রামে উদ্যোগটি পরিচালিত হচ্ছে। এ উদ্যোগের সঙ্গে কয়েক সহস্র স্বেচ্ছাব্রতী জড়িত। তারা এ পর্যন্ত অনেক উল্লেখেযাগ্য সফলতা অর্জন করেছেন। যেমন তারা প্রায় ৩০ লাখ ব্যক্তিকে সচেতন করেছেন। করোনাভাইরাস নিয়ে ভুল ও অপতথ্য প্রতিহত করতে ইমাম ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সহায়তায় তারা প্রায় পাঁচ হাজার প্রচারাভিযান পরিচালনা করেছেন। এ পর্যন্ত তারা প্রায় পৌনে চার কোটি টাকা মূল্যমানের অর্থ, খাদ্যসামগ্রী ও অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ করে প্রায় এক লাখ পরিবারকে সহায়তা করেছেন। তারা ৩৬ হাজার ব্যক্তিকে সরকারি সমাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আসতে সহায়তা করেছেন। প্রায় পৌনে ৪শ’ স্বেচ্ছাব্রতী কৃষকদের ৪২ একর জমির ধান কেটে দিয়েছেন।
করোনাভাইরাস মহামারি কায?র্?করভাবে মোকাবেলার লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনেক গুরুত্বপূর্ণ গাইডলাইন প্রকাশ করেছে। এসব গাইডলাইনের মধ্যে রয়েছে ‘রিস্ক কমিউনিকেশন ও কমিউনিটি এনগেজমেন্ট’ বা ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা ও কমিউনিটির সম্পৃক্ততা সৃষ্টি। দি হাঙ্গার প্রজেক্টের স্বেচ্ছাব্রতীদের করোনাভাইরাস-সহনশীল গ্রাম সৃষ্টির উদ্যোগ এ গাইডলাইনেরই প্রতিফলন, যা ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে শুরু করেছে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, দ্রুততার সঙ্গে করোনাভাইরাসের আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে হলে এ ধরনের উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই।
উদাহরণস্বরূপ, আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন সম্প্রতি লিখিতভাব বলেছেন :”কভিড-১৯-এর মহামারি আপনা থেকে নির্মূল হয়ে যাবে না। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া এটির লাগাম টেনেছে আগ্রাসী ‘কন্টেইনমেন্ট’ বা নিয়ন্ত্রণ ও ‘মিটিগেশন’ পদ্ধতির মাধ্যমে; শুধু তথাকথিত লকডাউনের মাধ্যমে নয়।” তার মতে, এই ‘করোনা রেসিলিয়্যান্ট গ্রাম’ একটি মডেল, যা শুধু গ্রামের জন্যই নয়; নগর ও শহরেও এটি বাস্তবায়নযোগ্য। এই মডেলটি সারা বাংলাদেশে ব্যবহূত হলে এক মাসের মধ্যে কভিড-১৯-কে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। অন্য দেশগুলোও আমাদেরকে অনুসরণ করবে।”
আমাদের মডেলটি বিদেশেও স্বীকৃতি পাওয়া শুরু করেছে। গত ২৩ জুলাই ‘লগইন এশিয়া’ নামে দিল্লিভিত্তিক স্থানীয় সরকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর একটি নেটওয়ার্ক করোনাভাইরাস-সহনীয় গ্রাম সৃষ্টির আমাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে একটি ‘ওয়েবিনার’-এর আয়োজন করে। এতে এশিয়ার অনেক দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেন এবং মডেলটি সম্পর্কে ব্যাপক আগ্রহ প্রকাশ করেন।
পরিশেষে, করোনাভাইরাসকে সত্যিকারাথের্? নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে আমাদেরকে জনগণকে সংগঠিত করে কমিউনিটি পর্যায় থেকে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এ লক্ষ্য করোনাভাইরাস-সহনীয় গ্রাম সৃষ্টির উদ্যোগটি হতে পারে একটি অনুকরণীয় মডেল, যার সঙ্গে সরকারি প্রচেষ্টা যুক্ত হলে সারাদেশে তা বিস্তৃত করা সম্ভব হবে। আমরা এ উদ্যোগটির প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ডিরেক্টর, দি হাঙ্গার প্রজেক্ট