আমেরিকান পদার্থবিদ স্টিভেন চু বলেন, ‘কথিত আছে, পাথরের যুগ কিন্তু পাথরের অভাবে শেষ হয়নি, বরং আমরা ভালো সমাধানের পথে পা বাড়িয়েছি। জ্বালানি দক্ষতা ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি আমাদের জন্য একই সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।’ যখন জ্বালানি দক্ষতা নিয়ে লিখতে বসেছি, সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশও করোনা আক্রান্ত অর্থনীতি ও উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। অনেক বিশ্নেষকই মনে করেন, অর্থনৈতিক খাতে কোনো কোনো দেশ ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দার সময়ের চেয়েও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। করোনা মহামারির কারণে, বিশ্বব্যাপী কারখানাগুলোতে উৎপাদন ব্যবস্থা স্থবির হয়ে যাওয়ায় কর্মীদের চাকরি থেকে ছাঁটাই এবং বেতন দিতে না পারা সে শঙ্কার কিছুটা বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, একটি লম্বা সময় বন্ধ থাকার পর কারখানাগুলো খুললেও করোনা ভয় এখনও রয়ে গেছে এবং সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চাহিদার ঘাটতি। বাস্তবতা বিবেচনায় নিলে কারখানাগুলোর এখন পরিচালন ব্যয় কমানো প্রয়োজন, এই বৈরী পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার জন্য। খরচ বাঁচানোর বিভিন্ন সুযোগের সঙ্গে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যাপারটিও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায়, পোশাক, সিমেন্ট, স্টিল, সিরামিকস এবং অন্যান্য শিল্পের অনেক কারখানাতেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জ্বালানির অপচয় হয় যা আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়- কখনও সেটি সক্ষমতার অভাবে, আবার কখনও অজ্ঞতার দরুন। বেশ কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন কারখানায় গড়ে নূ্যনতম ২০ শতাংশ জ্বালানি সাশ্রয় করা সম্ভব। উল্লেখ করা যেতে পারে, খুব অল্প সময়ে বিনিয়োগ উঠে আসায় জ্বালানি দক্ষতায় বিনিয়োগ অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট লাভজনক। জ্বালানি দক্ষতা বাড়ালে যেহেতু উৎপাদন খরচ কমে যায়, একটি কারখানা তার প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে বাজারে কিছুটা এগিয়ে থাকে যা তাকে নতুন বাজারে- বিশেষ করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রতিযোগিতায় সহায়তা করে।
জ্বালানি দক্ষতা বাড়াতে হলে একটি কারখানার কর্মপরিকল্পনা তৈরি করার সঙ্গে দেশে বা আন্তর্জাতিক বাজারে সহজলভ্য জ্বালানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ও যন্ত্র সম্পর্কে ধারণা রাখা প্রয়োজন। এরপর এই যন্ত্রগুলোকে কারখানায় স্থাপন করতে হবে জ্বালানি সাশ্রয়ের লক্ষ্যে। তবে, সর্বোচ্চ সাশ্রয়ের কথা বিবেচনায় নিয়ে, জ্বালানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ও যন্ত্র স্থাপনের পাশাপাশি যন্ত্র পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
জাতীয় প্রেক্ষাপটে, জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি জ্বালানি সাশ্রয় ছাড়াও জ্বালানি নিরাপত্তা, পরিবেশ সুরক্ষা, নতুন বিনিয়োগের সুযোগ এবং নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। কারখানার জ্বালানি সাশ্রয়ের ফলে সরাসরি বিদ্যুৎ এবং জ্বালানির চাহিদা কমে যাওয়ায়, দীর্ঘমেয়াদে দেশের জ্বালানি আমদানি কমে যাবে যা বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতেও যথেষ্ট প্রভাব ফেলবে। আবার জ্বালানি সাশ্রয়ের কারণে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের প্রয়োজনও কমে যাবে। ফলে সরকার অন্যান্য জরুরি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে পারবে- হতে পারে সেটি স্বাস্থ্য খাত অথবা সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর পেছনে বিনিয়োগ।
অনেকাংশেই এ কথা সত্য, সচেতনতার অভাব কিংবা কারিগরি দিক থেকে সক্ষম জনবলের স্বল্পতাই হোক, আর্থিক ও প্রযুক্তিগতভাবে অত্যন্ত আকর্ষণীয় জ্বালানি সাশ্রয়ী প্রকল্পগুলো অধিকাংশ সময় কারখানাগুলোতে বাস্তবায়িত হয় না। বলা চলে, এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কারখানার জ্বালানি বিভাগের প্রকৌশলী এবং কারিগরি কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের জ্বালানি ব্যবস্থাপনার ওপর প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। এর অংশ হিসেবে জার্মান ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন (জিআইজেড) দেশে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পোশাক, বস্ত্র ও ইস্পাত শিল্পের বিভিন্ন কারখানার সক্ষমতা এবং এ সংক্রান্ত সচেতনতা তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) এবং বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সঙ্গে সমন্বয় করে জিআইজেড গত বছর বস্ত্র ও পোশাক শিল্পের বাছাইকৃত ১৭টি কারখানার প্রকৌশলীদের জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ দিয়েছে। প্রশিক্ষণের পর অনুপ্রাণিত হয়ে কিছু কারখানা সহজে বাস্তবায়নযোগ্য জ্বালানি সাশ্রয়ের উপায়গুলো খতিয়ে দেখেছে এবং এর মধ্যে সেগুলো বাস্তবায়নও করেছে। অবশিষ্ট কারখানাগুলো মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানি দক্ষতার পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে প্রাথমিক পরিকল্পনা তৈরি করেছে। জিআইজেডের পাশাপাশি আরও অনেক উন্নয়ন সংস্থা জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য যে, কারখানার জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগের ফলে জ্বালানি নিরীক্ষক ও জ্বালানি ব্যবস্থাপকের মতো কাজের চাহিদা বাড়বে এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সেবা প্রদানকারী বেসরকারি কোম্পানি বিভিন্ন কলকারখানায় জ্বালানি সাশ্রয়ী যন্ত্র সরবরাহ করে তাদের ব্যবসার ক্ষেত্র বাড়াতে পারবে। বলে রাখা প্রয়োজন, কাজ এবং ব্যবসার এ সুযোগ পোশাক শিল্প থেকে শুরু করে সিমেন্ট, সিরামিকস এবং অন্য কারখানাগুলোতেও রয়েছে। সঠিকভাবে এগোতে পারলে, অদূর ভবিষ্যতে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি খাত অনেকের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে পারে।
করোনা মহামারি আজ যে সংকট সৃষ্টি করেছে, তাতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে স্বল্পতার কারণে, ব্যাংকিং খাত বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এক্ষেত্রে, করোনা-পরবর্তী সময়ে কারখানার জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধিতে ঋণ প্রদান আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসার পরিসর বাড়াতে এবং মুনাফা অর্জনে সহায়ক হবে। ভেবে দেখা যেতে পারে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সবুজ অর্থায়নের আওতায় যে পুনঃঅর্থায়ন স্কিম রয়েছে, সেটি কীভাবে আরও আকর্ষণীয় করা যায় যাতে কারখানাগুলো ঋণ নিতে আগ্রহী হয়। মনে রাখতে হবে, আমাদের করোনা-পরবর্তী পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায়, নতুন বিনিয়োগ যেন আর্থিক প্রতিদান দেওয়ার পাশাপাশি নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে এবং পরিবেশবান্ধব হয়। আর এটা হওয়া উচিত টেকসই উন্নয়নকেন্দ্রিক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। সে বিবেচনায় কারখানার জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ একটি আদর্শ ক্ষেত্র হতে পারে এবং খুলে দিতে পারে সম্ভাবনার দুয়ার।
প্রকৌশলী ও পরিবেশ অর্থনীতিবিদ; জ্যেষ্ঠ পরামর্শক হিসেবে আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত